PKC স্যারের জন্য একটি লাল গোলাপ


২০১৮ সালের দ্বিতীয় দিনটি বাঙলা ভাষার জন্য মন খারাপের দিন, গত রাতে বিদায় নিলেন PKC স্যারবাঙলা ভাষা হারাল তার এক প্রেমিককে আর তার ছাত্ররা, এমন এক শিক্ষককে যিনি শিক্ষকের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের বন্ধু হতে পরেছিলেন সহজেই হয়তো সময়ের কিছুটা আগেই বিদায় নিলেন নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস বিদ্যালয়ের সাবেক বাঙলা ভাষা শিক্ষক সকলের প্রিয় PKC , প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী স্যারশুধু বাঙলা ভাষার শিক্ষক বললে নেহাতই ধৃষ্টতা হবে, তিনি বাঙলা ভাষার প্রেমিকযার হাতের ছোঁয়ায়, উচ্চারিত শব্দে ভাষা কখনও ঈষৎ রাঙা হতো পূর্বরাগে আবার কখন প্রাচীন গুপ্ত গৃহ থেকে গর্জন করে  বেড়িয়ে আসে চর্যাপদের ছন্দ সাযুজ্যেকখনও পদাবলীর সনাতন লালিত্য কখনও রবি ঠাকুরের বিশ্ব চেতনা, তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হতো মন্ত্রের মতো

যে মন্ত্রে একটা নেশা ছিল আর সেই নেশা কখন যে তার অনেক ছাত্রের মতো আমাকেও পেয়ে বসেছিল কে জানেবাঙলা সাহিত্যের দিকপালরা যদি আমার মতো অসংখ্যকে লিখতে বা সাহিত্য চর্চায়ে উৎসাহিত করে তবে PKC স্যার এগিয়ে যাওয়ার সাহস যুগিয়েছিলব্যক্তি জীবনে এমন সদা চনমনে মানুষটি কোন দিন নিশ্চুপ হয়ে যাবেন সেটা ভাবতেই পারিনিকিন্তু 'মৃত্যু' নামের চিরন্তন সত্যের মুখোমুখি সকলকেই দাঁড়াতে হয় একদিন, আগে অথবা পরে

ছাত্র হিসেবে তাকে কাছ থেকে দেখছি অনেকগুলি বছরপড়ানোর সাথে সাথে কি ভাবে যেন তিনি ভাষার প্রতি একটা আবেগ তৈরি করে দিয়েছিলেনউদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী সুদর্শন এই মানুষটির শব্দ চয়নের ক্ষমতা বারেবারে বিস্মিত করতোভাষার প্রসাদ গুন কাকে বলে সেই সংজ্ঞা সেদিন জানা ছিল না, কিন্তু যেদিন ভাষার প্রসাদ গুন কাকে বলে জানলাম সেদিন প্রথম যার মুখ মনে পড়েছিল তিনি PKC স্যার

যারা তার ছাতার তলায় শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তারা জানেন, উৎসাহের নিরিখে এই মানুষটিকে তুলনা পাওয়া দুষ্করসাম্য দর্শন এই মানুষটির হাতেই ভিত্তি প্রস্থ স্থাপন হয়েছিল পরবর্তী সময়ে স্কুল ক্রিকেটে সাড়া জাগানো স্কুল ক্রিকেট দলটিরসঙ্গে নাটক, গান, কুইজ সব কিছুতেই উৎসাহ ছিল মানুষটির

বিদায় চির সত্য  কিন্তু কোন কোন বিদায় রেখে যায় স্থায়ী পদচিহ্নPKC স্যার ততদিন বেঁচে থাকবেন যতদিন তার ছাত্ররা বাঙলা লিখবে, PKC স্যার ততদিন বেঁচে থাকবেন যতদিন তার কোন ছাত্র অন্য কাউকে বাঙলা শেখাবে, কিংবা তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যেওআসলে শিক্ষকরা অমর, তারা জেগে থাকেন ছাত্রদের মধ্যেএই সদা জাগ্রত শিক্ষাব্রতীর শেষ যাত্রায় তাই শুধু মাত্র শোকের সাদা ফুল নয় তাঁর পায়ে রইল একটি লাল গোলাপ


তিনি বৃদ্ধ হলেন... AKM স্যার হাজির হলেন অন্যভাবে

তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। লম্বা, শিরদাঁড়া সোজা করে চলা মানুষটা বয়েসের ভারে একটু ঝুঁকে আছেন। ফিটফাট কটন ট্রাউজারর আর হাফ হাতা চেক শার্টের পকেটে রাখা একটি পেন। আজও হাফ সার্ট তবে সেটাও বয়েসের ভারে কিছুটা অবিন্যস্ত।
তিনি অবসর নিয়েছেন । অবসর নেয়নি তার ভিতরের শিক্ষক। তাই ছাত্রদের ছবি দেখে চেষ্টা করেন আজও ছোট ছোট ছেলে গুলোর মুখগুলোকে মনে করার। কিন্তু হাজার হাজার মুখের ভিড়ে সবাইকেই কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়। চোখের চশমায় পাওয়ার বেড়েছে কমেছে কানের ক্ষমতা। এক সঙ্গে ইংরেজি আর রসায়ন পরানোর বিরল কৃতিত্বের অধিকারী শিক্ষক আজ বৃদ্ধ হয়েছেন।
এহেন প্রিয় শিক্ষক আবার হাজির হলেন প্রায় ২০ টি বছর পর। সময়টা ১৯৯৬ সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তার পা ছুঁয়ে স্কুল গেট পেরিয়ে ছিলাম। তখন তো বুঝিনি আসলে যে গেট পেরচ্ছি সেই গেটের ভিতর রেখে যাচ্ছি আমার জীবনের সব থেকে দামি সময়টিকে। তা হলে হয়তো আরও ধীরে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে স্কুল গেটের বাইরে পা রাখতাম।
কিন্তু সেদিন তাড়াহুড়ো ছিল। বড় হবার তাড়াহুড়ো। তখন একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী কলেজে পরা যেত। সেদিন কলেজে ভর্তি হবার আগ্রহে একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এসেছিলাম আমার ছেলে বেলাকে ফেলে। শেষ বারের মতো স্কুলের মাঠে গিয়েছিলাম। আমি আর দেবরাজ চন্দ্র। ভালো করে দেখেছিলাম স্কুল বাড়িটাকে।
কথায় বলে বয়স বাড়লে বাড়ে মায়ার বাঁধান। কিন্তু কেন জানি সেই ছোট বয়েসেই শেষ বারের মতো ছাত্র হিসেবে বেড়িয়ে আসার সময় কান্না পেয়েছিল। গেট পার হলাম পা দিলাম এক নতুন জীবনে। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হয়ে গেলাম।
কথায় বলে ঢেঁকি সর্গে গিয়েও ধান ভাঙে। আমার হয়েছে তেমন অবস্থা। কথা হচ্ছিল ২০ বছর বাদে AKM স্যারকে অন্যভাবে খুঁজে পাওয়ার আর আমি জিয়াকে করে ফেলছি নস্টাল। পাঠক বিরক্ত হলে একান্ত ভাবে ক্ষমা প্রার্থী। তবে আমার এই ব্যক্তিগত আবোলতাবোল জার্নাল বন্ধুরা আর পরিচিতরা ছাড়া বিশেষ কেউ পরে বলে মনে হয় না। আশা তারা এটিকে লঘু দোষ বলে মাফ করে দেবেন।
১৯৯৬ থেকে সরাসরি চলে আসি ২০০৮ সালে। স্কুল কলেজ পেরিয়ে আমারা তখন যে যার পেশায় প্রবেশ করেছি। পূজার সময় আমারা কজন হাজির হলাম স্কুলে। পূজার সময়। তখন স্কুল ছুটি। যিনি তৎকালীন দারোয়ান তিনি তার কর্তব্যের খাতিরে আমাদের কোন ভাবেই ঢোকার অনুমতি দেবেন না। আমাদের অতি পরিচিত ‘তোপে’-দা তখন স্কুলে নেই। নেই বালেশ্বর দাও। থাকলেও ঢুকতে দিতেন কিনা সন্দেহ। এদিকে আমারাও নাছোড়বান্দা।
আনন্দশংকর  বিদেশ থেকে এসেছে, আমারা এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম, কোন ঘর খুলে দিতে হবে না একবার ঢুকেই বেড়িয়ে আসব ইত্যাদি কথায় দারোয়ান ভদ্রলোকের মনে বোধহয় একটু দয়া জন্মে ছিল। তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। (স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ, এই ঘটনার জন্য দয়া করে ঐ নরম হৃদয় মানুষটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন না। এর সমস্ত দায় আমাদের।)
ক্যামেরা ছিল আনন্দশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। গোটা স্কুল ঘুরে। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আমাদের ক্লাস ঘর গুলির দিকে উঁকিঝুঁকি মেরে , করিডোরে রাখা বেঞ্চের উপর বসে আমি , কৌশিক, অরিন্দম দত্ত আর আনন্দ বেশ কিছু ছবি তুলে ফিরে এলাম। পাঁচ মিনিট নয় আমারা স্কুলের ভিতরে ছিলাম প্রায় ৩০ মিনিট।
এবার ২০০৮ থেকে ২০১২ সালে। অর্কুট তখন চলছে নেট দুনিয়ায়। শিশু ফেসবুক তার সঙ্গে সবে পাল্লা দিচ্ছে। যে ছবি গুলো অর্কুটে ছিল আনন্দ সেগুলিকে ফেসবুকে পোস্ত করল। আমারা সবাই শেয়ার করলাম। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে এক অদ্ভুত ঘটনা। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাস ,ফেসবুকে মেমরি হিসেবে ভেসে উঠল স্কুল গেটের সামনের তোলা আমাদের একটি ছবি।  আমরা শেয়ার করলাম , মন্তব্য করলাম। ভালো নামের নিচে লিখে দিলাম আমাদের ‘কোড’ নাম গুলি।
কিছু এখানে অদ্ভুত কিছু নেই। হঠাৎ একটি ‘মেসেজ’ আমাকে বেশ অবাক করলো। একটি মেয়ে ফেসবুকে জানতে চাইলো আমি নিউআলিপুর মালটিপারপাসের ছাত্র ছিলাম কিনা। আশ্চর্য! বেশ অবাক হলাম। ভেবে দেখলাম কোন ভাবেই মেয়েটি চেনা নয়। তবে কি কারণে তার এই উৎসাহ? ভাবনা চিন্তা করে কিছু বুঝতে না পেরে জানালাম ‘হ্যাঁ’।
এবার আমার দ্বিগুণ অবাক হওয়ার পালা। মেয়েটি ফিরতি ‘মেসেজ’-এ জানাল ‘ দাদা, আমার বাবা ঐ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন’।
‘আমাদের স্কুলের শিক্ষক!’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
“হ্যাঁ-অজয় কুমার মুখার্জি-AKM স্যার”

“AKM- স্যার! তুমি স্যারের মেয়ে!” অচেনা মেয়েটি এক ঝটকায় অনেক দিনের চেনা মনে হোল। গুরু কন্যা তো পরিচিত হবারই কথা। গুরু কন্যার নাম অহনা। ছবি চাইলাম স্যারের। পরের দিন ছবি এসে গেল আমার ফেসবুকে। তার মধ্যেই স্যার কন্যার মাধ্যমে আমাদের  ছবি দেখেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই চিনতে পারেননি। শুধু বলেছেন আনন্দর মুখটা চেনা চেনা লাগছে। কি করে চিনবেন স্যার। তখন ১৬ আর এখন ৩৬। মধ্য তিরিশ পার করে দিয়েছি। মোটা হয়েছি কিছুটা। মাথার চুল পাতলা হয়েছে। একটা দুটোতে পাকও ধরেছে। আমারাও বুড়ো হচ্ছি স্যার।
আর যত বুড়ো হচ্ছি তত আপনাদের কথা বেশি করে মনে পরে। প্রতি দিন, জীবনের প্রতিটি বাঁকে আপনাদের  কথাগুলো ‘গুরু মন্ত্রের’ মত আজ কানে আসে। বাঙলা মিডিয়ামের ছাত্র তবুও যখন সায়েব সুবোদের সঙ্গে কথা বলি, বা সাহস করে ইংরেজি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি বারবার মনে হয় আপনি বলতেন ‘প্রিপজিশান’ টা ঠিক থাক বসানো খুব জরুরি।'
মনে মনে ভাবি একদিকে রসায়নের মত বিষয় অন্য দিকে ইংরেজি পড়ানো, বিঞ্জান আর সাহিত্য এসে কি ভাবে মিলতও একটি বিন্দুতে। এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি। শিখতে হবে ঐ অগাধ পাণ্ডিত্য নিয়েও কি করে এতটা নিরহংকার থাকতেন, শিখতে হবে আমাদের মতো পাজিদের এত ঠাণ্ডা মাথায় কি ভাবে সামলাতেন। শুনলাম আপনার শোনার ক্ষেত্রে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। বলার ক্ষেত্রে তো সমস্যা নেই স্যার।
তাহলে একটা ক্লাস করার না। সেখান না কি ভাবে আপনার মতো মানুষ হওয়া যায়। ব্লাক বোর্ড বেঞ্চ নাই বা থাকলো। আপনি খাটে বসবেন আর আমারা মাটিতে। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন। প্রণাম নেবেন।

ছবিঃ অহনা এবং ফেসবুকের বন্ধুদের থেকে নেওয়া
Arindam

   


                                মাদার এবং আদার বিষয়: হাম্বা থেকে  সাম্বা                                  




কে বলে ভারত নাকি জাদু টোনার দেশ? কে বলে ভারত নাকি বাবাজি-মাতাজীর দেশ? কোন ব্যটা বলে শুধুমাত্র ভারত নাকি অলৌকিকবাবাদের কারিগুরির দেশ? এখন তো দেখা যাচ্ছে "উল্টো পুরাণ", ভারতীয়দের টেক্কাদিচ্ছে রোমপোপ ঘোষণা করেছেন মাদারনাকি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী

আমাদের পাড়ার পাঁচুএকদিন এসে বলল আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিআমারা তো অবাকযে পাঁচু জীবনে মাঠেই নামে নি সে প্রথম হোল কি করে? কোথায় প্রতিযোগিতা ছিল জানতে চাওয়ায়? পাঁচু বললো কেন আমার বাড়ির উঠোনেকে রেফারি ছিল ? ‘কেন আমিই রেফারি ছিলামআর কে তোমার সঙ্গে  দৌড়ে ছিল? ‘কেন আমি একা। 

বিষয়টা এই রকম, মাদারের আলৌকিতার পরীক্ষাও নিলেন পোপের নির্ধারিত লোকেরা, পরীক্ষা দিলেন তিনিও মাদারের ভক্ত, আর যারা বিশ্বাস করলেন তারাও পোপের বিশ্বস্তগর বার ভারতে এক জনকে খুঁজে পেয়েছিলেন ঐ পরীক্ষকরাযিনি নাকি অলৌকিক উপায়ে মাদারের আশীর্বাদে রোগ সারিয়ে ছিলেনকিন্তু ভারতের যুক্তিবাদীরা খুঁজে বার করেছিলেন আসলে তার রোগ সেরেছিল চিকিৎসার মাধ্যমেতার জন্যই কি এবার ভারত থেকে সরে গিয়ে ব্রাজিলেহাম্বাথেকে সোজা সাম্বা

একদিন 'পাঁচু' এসে বলল রোজ রাতে সে দুই ফুট করে লম্বা হয়ে যায়আর তার ঘাড়ের দুই দিক ঠকে দুটো ডানা গজায়সেই ডানায় ভর করে সে  উরে যায় গঙ্গার ধারেসেখানে একটু হওয়া খেয়ে সে জি পি ও -এর উপর গিয়ে বসেতার পর বাড়ি ফিরে এসে সে ঘুমিয়ে পরেঅমনি তার উচ্চতা আগের মতোই হয়ে যায়আর ডানা গুলোও 'ভ্যানিস' হয়ে যায়সবাই বলে পাঁচুর মাথায় 'ছিট' আছেপাঁচুকে যদি পাগলা বলা হয় তাহলে 'মন্ত্র' পড়ে টিউমার সারানোর দাবীদারকে কেন চোখ বুজে বিশ্বাস করতে হবে?

বাবাজিরা ছাই-টাই  আনলে তাকে হাতেনাতে ধরা যায়, মাদারিররা শূন্য থেকে মাদুলি আনলে তার সামনে আর একটা বাবাদুলি নিয়ে আসা যায়, কিন্তু কারো মৃত্যুর পর তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বললে সেই উপায়টা নেইতাই মাননীয় পোপ’ –কে অনুরোধ আপনি দয়া করে এমন কারোকে সামনে আনুন যিনি জীবিত এবং অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীআমারা অবিশ্বাসী’-রা একটু প্রমাণটিকে ঠুকে বাজিয়ে নেব


 আর যদি প্রমাণ করতে না পারেন তবে এই ভণ্ডামিগুলি বন্ধ করুনতা না হলে ইতিহাস আপনাকে   ভণ্ডবলেই মনে রাখবে

Arindam




আমার ক্লাসের লম্বাবন্ধুটি
লম্বা, দীর্ঘ সারিবদ্ধ ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মধ্যে তাকে বিশেষ ভাবে চোখে পড়ছেউচ্চতায় অন্যদের বেশ খানিকটা পিছনে ফেলে নিজের ডান হাত দিয়ে মাঝে মাঝে মাথা চুল ঠিক করে নিতে নিতে এদিকে ওদিক দেখে নিচ্ছে সেকিছুটা বিরক্ত, আর কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে কে জানে! এমন একটা ভাবহাফ হাতা শার্ট আর জিন্সের প্যান্টবাঁ হাতে একটা সবুজ ফাইলসেই ফাইলটা কখন কখন মাথার উপর তুলে বেলা সাড়ে বারোটার রোদকে আড়াল করার চেষ্টা করছেলাইনে দাঁড়ানো সবাই কেউ সোজাসুজি আবার কেউ আড়চোখে অন্তত একবার হলেও দেখে নিচ্ছে তাকে।  তার কারণ একটিইছেলেটির উচ্চতাগঙ্গাতীরের বঙ্গবাসীর কাছে লম্বামানেই বিগ বি, আর এই সেই বিগ বি কেও এই ছেলেটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে হাসতে হাসতেসে আর কেউ নয় আমার স্কুল বেলার লম্বাতমবন্ধু শুভদীপ বিজয় ভট্টাচার্য

জীবনে একবারই আমি সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলামতখন কলেজে পড়ি সেই সময় টালিগঞ্জের পি এস সি অফিসে সরকারি চাকুরীর পরীক্ষার ফর্ম জমা নেওয়া হোতোপাড়ার সবার বিনে পয়সায় হাত দেখে বেড়ান বল্টু দা জোর করে আমার হাতটা টেনে নিয়ে সেটা দেখে বলেছিল, ‘চান্স তো নে ,লেগে গেলেও লেগে যেতে পারেতবে আমার ওটাই ছিল প্রথম এবং শেষ চান্স নেওয়াএবং সমস্ত জ্যোতিষের মতোই বল্টুদার গননাও ফেলকরেছিলসেই ফর্ম জমা দেওয়া লাইনেই আমার সামনে দাঁড়ান বেশ কিছু ছেলেমেয়ের আগে শুভদীপকে পিছন থেকে দেখাই চিনতে পেরেছিলামএ শুভদীপ বিজয় ছাড়া আর কেউ হতেই পারে নাদিলাম এক ডাক, একবার ...দুবার...তিনবার ডাকতে যাবো ঘাড় ঘুড়িয়ে হাত নাড়ল সেপিছনের ছেলেটিকে লাইন রাখতে বলে বেড়িয়ে আমার সামনে এসে হাজিরএর মধ্যে অনেকেই তাকে মাথা ঘুড়িয়ে ,চশমা নামিয়ে দেখছেকেউ কিছুটা অবাক চোখে কারো চোখের ভাষায় লেখা , ‘ইস্ আমি যদি আর একটু লম্বা হতাম!’ এতো গেলো সোজাসুজি দেখাআড় চোখেরও বেশ কিছু দৃষ্টিতে নানা ভাষা লেখা ছিলএকে ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি তার উপর ফর্সা রঙ, সুন্দর চেহারা এককথায় যাকে বলে সুপুরুষ, এহেন সুপুরুষকে আড়চোখে যে দেখাদেখি হবে সেকথা বোধহয় শুভদীপের ততদিনে গা সওয়া হয়ে গেছেসেই কারণেই সে ঐ সব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে আমার সামনে হাজির হয়ে প্রথমেই বলল, ‘লম্বা লাইনটা দেখেছিস’? কথার মধ্যে যেন মার্চ মাসের দুপুরে বিশ্বায়ন, উষ্ণায়ন, দেশ- রাজ্যের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিল্প, কৃষি, রাজনীতি নানা রকম বিষয়ের অভিব্যক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।  লাইনের দৈর্ঘ্য টালিগঞ্জের পি এস অফিসের গেট থেকে পাশের রাস্তা দিয়ে পি এস সি অফিসকে অর্ধেক চক্কর মেরে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছেপি এস সি অফিসের সামনের ফুটপাতে বেশ কয়েক জন বই বিক্রেতা চাকুরীর পরীক্ষার বই নিয়ে বসে আছে সঙ্গে আছে অন্য অন্য চাকরির ফর্ম। সেখানে কিছু ছেলেমেয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে কেউ কেউ ফর্ম গুলিকে খুঁটিয়ে দেখছে , যেন সেগুলি একেকটি লটারির টিকিট। এদের মধ্যে কেউ আমাদের মতই কলেজ ছাত্র আবার কারো চুলে তখনই হালকা পাক ধরেছে



চল একটা ব্যবসা করিচাকরির পরীক্ষার ফর্ম জমা দেবার লাইনে দাঁড়িয়ে নতুন ব্যবসার পরিকল্পনা! বিষয়টা শুধু অভিনবই শুধু নয়, বিল গেটস বা জুকেনবার্গ সাহেব শুনলেও হয়ত কিছুটা অবাকও হবেনকথাটা শুনে লাইনে দাঁড়ানো আমার সামনের চশমা পরা ছেলেটা চশমার ফাঁক দিয়ে সম্ভবত অবাক হয়েই ফিচেল চোখে একবার  তাকিয়ে ছিল, মনে আছেসে যাই হোক লম্বু’-এর সঙ্গে সেদিন আর ব্যবসার পরিকল্পনার কথা এগোয় নিএই নিয়ে অন্য একদিন বসে আলোচনা করা হবে এই কথা দিয়ে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলামতখন বি এস এন এল-এর ল্যান্ড ফোনের যুগ চাকা ঘুড়িয়ে নম্বর ডায়াল করা ফোনের জায়গায় সদ্য এসেছে বোতাম টেপা ফোন। ইন্টার নেট ই-মেল এই বস্তু গুলো আমাদের জীবনে তখনও পা রাখেনি তাই অগত্যা ফোন নম্বর আদানপ্রদান

ফোন নম্বর আদানপ্রদান হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তখন তো জানতাম না মানুষের ভিড়ে এই ভাবে হারিয়ে যাবো আমারাতাই হয়তো বাসের টিকিটের পিছনে লেখা ফোন নম্বর মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে কখন হারিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনিতবে ফোন নম্বর হারালেও স্মৃতিটা অক্ষত আছেযত দিন বেঁচে থাকব সে হারাবেও নাতাই যখন একা থাকি, কিংবা কোন কারণ ছাড়াই যখন মন খারাপ হয় অথবা যখন জীবনে কিছুটা বাড়তি অস্কিজেন দরকার হয় তখন আমি ফিরে যাই, নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস-এর ক্লাসঘর গুলোয়আর সেই সুযোগে ক্লাসঘরগুলো সুযোগ পেলেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমাকে

সেই স্মৃতি সরণীতেই দেখতে পাচ্ছি সেই ফেলে আসা দিনগুলি যখন প্রথম আমাদের বন্ধুদের তালিকায় যুক্ত হল শুভদীপ বিজয় ভট্টাচার্যসাদামাটা ছেলেপড়াশুনায় মধ্য মেধার, শান্ত, অল্প কথা বলেবিশেষত্ব একটাই লম্বাক্লাসের কেউ কেউ দুষ্টুমি করে দাদা’ , ‘কাকা’, ‘মামাবলেও সম্বোধন করতে লাগলআমারা যারা একেবারে ইনফ্যান্ট থেকে একসঙ্গে পড়ছি তাদের সঙ্গে প্রাথমিক অবস্থায় কিছুটা দূরত্ব ছিল শুভদীপেরতবে বাকিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব্ব হতে সময় বেশি লাগলো নাবছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাদের বন্ধু হয়ে উঠল

বেশ ভালোই জমে উঠেছিল আমাদের বন্ধুত্ব, ঝগড়া, তর্ক ,মারামারিএমনই একদিন শুভদীপ এসে জানালো সে চেতলার রাখি সঙ্ঘক্লাবে বাস্কেট বল খেলতে শুরু করেছেসেদিন আমার ধারণা হয়েছিল সে একজন ভালো বাস্কেট বল খেলোয়াড় হবে হয়ত লম্বা বলেই। তখন পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট কোচিং সেন্টার গুলি এখনের মতো গজিয়ে ওঠেনি। সৌরভ গাঙ্গুলি তখন বাঙলা দলে খেলার জন্য চেষ্টা করছেন। তার মধ্যে বাস্কেট বল বেশ অভিনব ব্যবপার ছিলো। আমার ধারণা ছিল এই খেলা আমেরিকার কালো মানুষরাই বুঝি খেলে।  শুভদীপ  মাঝে মাঝে এসে গল্প করতো তার খেলারআমরাও বেশ উৎসাহ নিয়ে শুনতামতারপর স্কুলের পাট শেষ হোলস্কুলের গেট পেরিয়ে হাজির হলাম এক মজার জায়গায়যাকে বলে বৃহত্তর সমাজসামনে তখন গোটা পৃথিবীআর সেই নতুন পৃথিবীতে মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে আমাদের কোন বাঁধা ছিলনাআমারা মিশেও গেলাম জনসমুদ্রেসেই সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে নিউ আলিপুর পেরিয়ে গোলপার্ক, পেরিয়ে চাকরি আর চাকরি পেরিয়ে ব্যবসা, সংসার, মাথায় একটা দুটো করে সাদা চুলের উঁকিঝুঁকি আরও কতো কি





বাসের টিকেটের পেছনে লেখা ফোন নম্বরের মতো কখন যেন হারিয়ে গেল অনেকটা সময়ওতবে বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত যতবার চেতলার পথ দিয়ে চলাফেরা করেছি অনেক অনেক স্মৃতির ভিড়ে একবার উঁকি দিয়েছি রাখি সঙ্ঘ’ –এর বাস্কেট বল মাঠেযদি দেখতে পাই আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকেযদি খুঁজে পাই সেদিনে সেই হারিয়ে যাওয়া বাসের টিকিটটানা পায়নিজানি পাওয়া সম্ভবও নাকিন্তু আমার বন্ধু কখনই হারায়নিতার সঙ্গে আজও হঠাৎ হঠাৎ  দেখা হয়ে যায়, স্মৃতির সরণীতে।  যেমন আজ হলঅনেকটা সময়ও কাটালামআড্ডা হোল অনেকক্ষণতবে বলতে পারবো না এখন তাকে দেখতে কেমন? মোটা হয়েছে না রোগা, বলতে পারব না তার মোবাইল নম্বর বা ই-মেলের ঠিকানাতবে তার একটি বাসা আমি বিলক্ষণ চিনি , সেটি আছে আমার মস্তিষ্কেযেটা আমার স্কুল বেলার এক আস্ত কলকাতা, যার প্রতিটি গলিতে ,যার প্রতিটি রাস্তাতে আমার এক একজন বন্ধুর বাড়ি ,আমার ছেলে বেলার ঠিকানা সেই শহরের ছোট্ট একটা গল্প রইল সবার জন্য।
-অরিন্দম চ্যাটার্জী


ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান এবং আমার স্কুলবেলা
সদ্য শেষ হয়েছে কলকাতা ফুটবল লিগ। লীগের শেষ বড় ম্যাচ ছিল ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের। আজকাল বড় দলের খেলাগুলিকে ‘ডার্বি’ বলা হচ্ছে। আগে রেসের মাঠে ‘ডার্বি’ শব্দটার খুব চলছিল। এখন ফুটবল মাঠে এই শব্দটা বেশ চালু। বিদেশের মাঠেও বড় ম্যাচগুলিকে ‘ডার্বি’ বলাহয়।
খেলা  হল তার ফলাফলও এলো, তার সঙ্গে বাড়তি এলো বেশ কিছুটা উত্তেজনা। চিরন্তন সেই উত্তেজনা! যা ইলিশ বনাম চিংড়ি দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় দেশ ভাগ, উদ্বাস্তু , ঘটি বাঙালের লড়াই দিয়ে। এই লড়াই চলছে চলবে।
এরই ফাঁকে আরও একটা ঘটনা ঘটে গেল। কলকাতার ঘটি-বাঙালের লড়াইয়ের মাঝে যে খবর নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পাননি ফুটবল প্রেমীরা। অন্তত কলকাতার ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের সমর্থকরা। এই চোখে না পরা খবরটি হোল এই সময়েই যোগ্যতা নির্ধারণ ম্যাচে হেরে আবার বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন পর্ব থেকে বিদায় নিলো ভারত।
এটা অবশ্য বড় খবর নয়, কারণ এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু হলে তখন সেটা খবর হয়। সে যাই হোক ভারত   নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বকাপ খেলবে এটা জেগে জেগে কল্পনা করা কষ্টসাধ্য। তবে এর জন্য ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের লড়াইটা কিন্তু থেমে নেই। থেমে নেই ঘটি-বাঙালের মিষ্টি ঝগড়া।
এই লড়াইয়ের যত্ন করে জমিয়ে রাখা স্মৃতি আছে আমার ঝুলিতেও। তখন ক্লাস সেভেন কি এইট হবে। সেই সময় আমাদের ক্লাসে আড়াআড়ি দুটো দল হয়ে যায়। একটা যারা ইস্টবেঙ্গলকে সমর্থন করে আরেক দল মোহনবাগান।
আর এই দুই দলে ‘বড় ম্যাচ’ নিয়ে চলত  তীব্র বিতর্ক। ‘তীব্র’ শব্দটিকে যতটা তীব্র ভাবে উচ্চারণ করায়ায় আমাদের বিতর্কটা ছিল ততটাই তীব্র। এই দুই ভাগের মধ্য স্পষ্ট মনে আছে গৌতম সরকার আর অরিজিত দাসকে। এরা ছিল আমাদের বিপক্ষে। মানে মোহনবাগানের দলে। আরও অনেকে ছিল। বেশ ভারি দল ছিল মোহনবাগানের। তবে বাঙালদের দলও কম ছিল না।
ওদিকে তখন শিশির ঘোষ এদিকে তখন কৃশানু-বিকাশের যুগ। সঙ্গে ছিলেন চিমা ওকেরির মত স্টাইকার। এখনও মনে আছে সেই সময়ও দেশি-বিদেশী খেলোয়াড় নিয়ে তর্কটাও ছিল। আজ আর বিদেশী খেলোয়াড় নিয়ে ছুতমার্গ নেই। এখন বিদেশীরাই এই দুই ক্লাবের তারকা খেলোয়াড়।
আমাদের দলে আমি ছিলাম তার্কিকদের মধ্যে একজন। যেদিন খেলা থাকতো সেদিন টিফিনের তর্ক যুদ্ধ মল্ল যুদ্ধের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে যেত। তবে এই কথা হলফ করে বলতে পারি এই নিয়ে মারামারি  কোন দিনও হয়নি।
আমাদের মধ্যে ভালো ফুটবল খেলত শান্তনু রায়, মানে আমাদের ‘ব্যাঙ’। সৌমেন কর(মামা)-এর পায়ের কাজও ভালো ছিল। একটা দুটো গোল এক কলমচিও দিয়েছে । তবে ক্রিকেটের সাথে সাথে ফুটবল নিয়েও আগ্রহ ছিল একথা বলাই বাহুল্য । ঠিক যেমন আগ্রহ ছিল ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা নিয়েও।
তবে বয়স বাড়লেও তর্কের সেই উত্তেজনা যে কমেনি সেটা আঁচ পেলাম আমাদের নতুন ক্লাস ঘরের দেওয়ালে। মানে ফেসবুকের ওয়ালে আর কি! রক্তের রঙ সবুজ-মেরুন বলে দাবী করা অরিজিত দাস খেলার এক দিন বাদে যুক্তি-টুক্তি সাজিয়ে, পরিসংখ্যানের পরসা নিয়ে একটা ‘স্যাটাস’ দিলো। আর যাবে কোথায় । খেলায় জিতেছে ইস্টবেঙ্গল তারাও গরম গরম মন্তব্যে ভরিয়ে দিল  অরিজিতের ফেসবুকের দেওয়াল।
ব্যাস শুরু হয়ে গেল লড়াই। বেশ মজার! খোঁচার পাল্টা খোঁচা, তার জবাবে আবার খোঁচা। তার  উত্তরে আরেক খোঁচা। এত খোঁচাখুঁচি হলে আহত হবার সম্ভাবনা থাকেই। হলও তাই। এক বন্ধু আহত হলেন। অভিমানের রক্তপাতও হোল ,তবে কিঞ্চিৎ! তিনি ব্যক্তিগত স্তরে অনুযোগ করলেন। কিন্তু তার অনুযোগ মিটতে সময় লাগল খুব বেশি হলে তিরিশ সেকেন্ড। আরে বাবা ‘ইয়ে ফেভিকল কা মজবুত জোর হ্যায়, টুটেগা নেহি’।
হ্যাঁ সে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান হোক বা সি পি এম- তৃণমূল। স্কুলের বন্ধুদের ‘মজবুত জোর’-এর দেওয়ালে ফাটল ধরাতে এরা কখন পারেনি আর পারবেও না।
কলকাতার ফুটবল নিয়ে আমার ব্যক্তিগত উৎসাহ আজ আর নেই। নিয়মিত খেলাও দেখিনা , বলা ভাল কখনও দেখার সময় পাইনা আবার কখনও ইচ্ছে করে দেখি না । এর একটা কারণ অবশ্যই এই ক্লাবগুলির কিছুকিছু কর্মকর্তারা। যারা মনে করেন ক্লাবগুলি তাদের মৌরসি পাট্টা।
তবুও একজন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হয়ে ভালো লাগে যখন  জাতীয় লিগ জেতার পর সুদূর আমেরিকায় আকাশে অরিজিত মোহনবাগানের পতাকা ওড়ায়। আমেরিকায় অরিজিতের বাড়ির জানলা দিয়ে উড়তে থাকা পতাকা ১৩,৯২৭ কিলোমিটার দূরে এসে কলকাতায় কোথায় যেন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ছাড়িয়ে বাঙালির কথা বলে।
আসলে পতাকার রঙ যাই হোক না কেন সেটা বাঙালির ফুটবলের পতাকা। যে বাগালি হয়তো বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নও দেখেননা কিন্তু মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে তার নিজের ক্লাবকে। হয়তো পুরটাই আবেগ, কিন্তু এই আবেগ তো আসলে ফুটবলের প্রতি ভালবাসারই। তাই বেঁচে থাকুক তর্ক, বেঁচে থাকুক ফুটবল নিয়ে ঝগড়া আর বেঁচে থাকুক ‘বাঙালির প্রিয় ফুটবল’।
অরিন্দম চ্যাটার্জি

৫০শে পা মিত্তির দা--রজনী সেন রোডের বাড়িতে কিছুক্ষন
এখন মিত্তির দা
মিত্তির মশাই পা দিলেন ৮৫ বছরে ৮৬ -৮৭ ও হতে পারেতবে আমাদের পরিচয়ের বয়স পঞ্চাশ বছরমিত্তির মশাই না বলে যেমন এতদিন যেভাবে  বলে এসেছি তেমন ভাবে মিত্তির দা বলাই ভালোতিনি বৃদ্ধ হয়েছেন তাই বলে সম্পর্কটা তো আর বুড়িয়ে যায়নিতাই এই বয়েসেও তিনি তরুণ মিত্তির দা

রজনী সেন রোডের বাড়িতে কড়া নাড়তেই দরজা খুলল একটি ফুটফুটে মেয়েমিত্তিরদা বাড়িতে আছে কিনা জানতে চাইবার আগেই বলল, ‘পনেরো মিনিট বসতে হবে দাদু ব্যায়াম করছেমিত্তিরদা তাহলে ব্যায়ামটা ছাড়েননিঅনেক দিনের অভ্যাস,জ সকালে ঘড়ি ধরে ব্যায়ামঅগত্যা ১৫ মিনিট অপেক্ষাইতি মধ্যেই হাজির চাঠিক পনের মিনিট পরে ঘরে ঢুকলেন মিত্তিরদা৮৫-৮৬  বছরেও ছিপছিপে চেহারাটা ধরে রেখেছেনমাথার চুল গুলো সব সাদা হয়ে গেছেচোখে চশমা, তবে তার ভিতর দিয়ে উঁকি মারছে চিরপরিচিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দুটি চোখ

নিখুঁত কামানো গালে পড়েছে বলি রেখায় জ্যামিতিক চিত্রতবে দুটি ভুরু মাঝে যে তিনটি ভাঁজ পড়ত সেটা অবিকল একরকমই আছেগায়ে সাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা

উল্টো দিকের চেয়ারে বসলেন মিত্তির দাভালো করে দেখে নিলে আপাদমস্তকপ্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাজির সেই ছোট্ট মেয়েটিএক লাফে উঠে বসল দাদুর কোলে
আমার নাতনি, ক্লাস থ্রিতে পড়েবলে নাতনির মাথায় হাত বুলতে থাকলেন মিত্তির দাটেবিলের উপর একটা কাঁচের অ্যাশ ট্রে, ফাঁকাচারমিনারের একটা টুকরোও তাতে নেইতবে কি মিত্তিরদা.... ভাবতে ভাবতেই প্রেয় অন্তর্যামীর মতো বলে উঠলো মিত্তির দা
সিগারেট ছেড়েছি বছর পনের আগেও বস্তুটিতে মগজ খোলা না বরং মগজের ক্ষতি হয়একদিনেই ছাড়লামঅনেক দিনের অভ্যাস জানোই তোকয়েকটা মাস অসুবিধা হয়েছিল তার পর থেকে সব ঠিক
এখন বাড়িতেই থাকেনমাঝেমাঝে নাতনিকে নিয়ে সামনের পার্কে হাঁটাহাঁটিতবে বাড়িতে আমার মতো ভক্তের ভিড় লেগেই থাকেঅনেকেই মিষ্টি নিয়ে আসেনকিন্তু মিত্তিরদা চিরকালই খুব অল্প খান
রায় বাবু তখন অসুস্থ শেষ কেসটা সমাধান করলামতার পর থেকে আর কেস নি নাআর বয়সও তো হোলবাড়িতে বসে বই পরে আর গান শুনেই সময় কাটেআর এই নাতনির সঙ্গে খেলাধুলা
ভাইপো এখন  ব্যবসায়ীচাকরি ছেড়ে স্বাধীন ব্যবসা করছেরেস্তরাঁ চেইন-এর মালিকসঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা তো আছেইবেশ নাম ডাক হয়েছেএই খবরটা জানাই ছিলোতাই জানতে চাইলাম-
গাঙ্গুলি বাবুর খবর কি? তিনি আছেন কেমন?”
আছে ভালোই আছেতবে বাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেডাইবেটিসও আছেডাক্তারের বারণ এড়িয়ে এখনও চপ-কাটলেট সাবাড় করে দেয় মাঝেমাঝেআসলে খেতে এখনও খুবই ভালোবাসেশুনেছি ভাইপোর রেস্তরাঁতে মাঝে মাঝে অন্য নামে অর্ডার দেয়ডাক্তারের নির্দেশে অনেক কিছুই বন্ধআসতে পারে নাতব প্রতি হপ্তায় ফোন করেলেখালিখি খুবই কমিয়ে দিয়েছেঐ পূজা সংখ্যার জন্য যেটুকু লিখতে হয় সেটুকুই লেখেতবে প্রখর রুদ্রের বয়স কিন্তু এখন একটুও বাড়েনি
দিনকাল কেমন বুঝছেন? খুন জখম তো বেড়েই চলেছেসাহস করে প্রশ্ন করে বসলাম
দেখো ভাই শুধু খুন হবার পর খুনিকে খুঁজে বার করাটা গোয়েন্দার কাজ  খুন হবার আগে সেটা বন্ধ করাটা কিন্তু একমাত্র করতে পারে প্রশাসনআমার আজ আপসোস হয় কাশীর  গলিতে যদি বৃদ্ধকে...... যদি খুন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারতামমাটির মানুষ ছিলেন.... মনে নেই জয়বাবা.......?”

বিলক্ষণ মনে আছেসে কি ভোলা যায়?” কথা লুফে নিয়ে উত্তর দিলাম
খুন জখম বেড়েছে, চুরি ছিনতাই বেড়েছে, কিন্তু সেগুলি রুখতে আর কোনো মিত্তির দার দেখা নেই কেন?” প্রশ্ন শুনে হালাকা হাসলেন মিত্তির দা
রায় বাবু না থাকলে মিত্তির হয় না ভাই! উনি চেহারায় শুধু লম্বা ছিলেন না, মানুষটাও ছিলেন অনেক উঁচু দরেরসেরকম আজকাল আর দেখা যায় নাএকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মিত্তির দা
কেন এখন বাঙলায় বুদ্ধিজীবীর ছড়াছড়ি
অর্থনীতি পড়েছ ছোকরা? পড়ে থাকলে চাহিদা আর জোগানের তত্ত্বটা জানো নিশ্চয়ইএই ছড়াছড়ি বলেই মাথা বিকবার এতো হুড়োহুড়িকথা বলতে বলতে আবারও চা এসে গেলোচশমাটা খুলে চায়ে চুমুক দিয়ে মিত্তিরদা বললেন-
ভাই ইন্টেলেকচুয়ালরা রাজনীতিকে পথ দেখাবে তারা রাজনীতিকদের পিছুপিছু কেন হাঁটবেন? বুদ্ধি একটা আত্মাভিমানের জন্ম দেয়সেটা খারাপ নয় বরং ভালোযে মুহূর্তে বুদ্ধির আত্মাভিমান কমে যায় তখন সে দালালে পরিণত হয়
কিন্তু আপনি তো কোন দিন সেভাবে রাজনৈতিক কথা বলেন নি...তবে আজ হঠাৎ করে?” প্রশ্নটা করেই ফেললামমিত্তির দার মুখে  এর আগে এই সত্যিই ধরনের কথা শুনিনি
কে বলল এই কথা? ভালো করে একবার পড়ে  দেখবে গল্পগুলোরাজনীতি মানে কিন্তু শুধু পলিটিকাল দল গুলোর কাজকর্ম নয়এর বাইরেও একটা রাজনীতি আছেএবার সেই রাজনিতীর দিকটায় নজর ফেরান দরকারকথা শেষ করে লম্বা চুমুক দিলেন চায়ে
রাজ্যের কথা কি বলবেন? কি বুঝছেন পরিস্থিতি?” প্রশ্ন করলাম
বাঙালির মগজাস্ত্রে জং পরেছে ভাই...আজ থেকে নয় অনেক দিন থেকেই...ওটাতে জং পড়তে দিও না...ঘড়ির দিকে তাকালেন মিত্তিরদাআমায় দেওয়া সময় শেষ হয়েছেআমাকেও এবার উঠতে হবেবিদায় চাইতেই হেসে বললেন
এখন আমার ভায়োলিন বাজাবার সময়বুড়ো বয়েসে নাতনির সঙ্গে আমিও শিখছিজানতো হোমস সাহেবও শেষ বয়সে ভায়োলিন বাজিয়েই সময় কাটাতেন
তাহলে এখন এই ভাবেই সময় কাটে?”
বলতে পারোতবে মনের দরজা জানলা খুলে রেখেছি ,আলোবাতাস যাতে খেলতে পারেতোমাদের সিধু জ্যাঠার কথাটা মনে আছে তো...তিনি বলতেন...মনের জানলা  কখন বন্ধ করো না.....আমি তাই বলি মনের দরজা জানলা দিয়ে একটু হাওয়া রোদ আসতে দাও দেখবে সমস্যা গুলোর সমাধান নিজেরাই তোমাদের সামনে চলে আসবেভালো থেকো সকলে

মিত্তিরদা উঠে দাঁড়ালেনধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে আমি রজনী সেন রোড ছেড়ে বেরুচ্ছি কানে এলো ভায়োলিনের শব্দমনে পড়ল মিত্তির ঐ কথাটা  বাঙালির মগজাস্ত্রে জং পরেছে ভাই...আজ থেকে নয় অনেক দিন থেকেই...ওটাতে জং পড়তে দিও না...

 

Arindam