মিত্তির মশাই পা দিলেন ৮৫ বছরে ৮৬ -৮৭ ও হতে
পারে। তবে আমাদের পরিচয়ের বয়স পঞ্চাশ বছর। মিত্তির মশাই না বলে যেমন এতদিন যেভাবে
বলে এসেছি তেমন ভাবে মিত্তির দা বলাই ভালো। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন তাই বলে সম্পর্কটা তো আর বুড়িয়ে যায়নি। তাই এই বয়েসেও তিনি তরুণ ‘মিত্তির দা”।
রজনী সেন রোডের বাড়িতে কড়া নাড়তেই দরজা খুলল
একটি ফুটফুটে মেয়ে। মিত্তিরদা বাড়িতে আছে কিনা জানতে চাইবার আগেই
বলল, ‘পনেরো মিনিট বসতে হবে দাদু ব্যায়াম করছে’। মিত্তিরদা তাহলে ব্যায়ামটা ছাড়েননি। অনেক দিনের অভ্যাস,রোজ সকালে ঘড়ি ধরে ব্যায়াম। অগত্যা ১৫ মিনিট অপেক্ষা। ইতি মধ্যেই হাজির চা। ঠিক পনের মিনিট পরে
ঘরে ঢুকলেন মিত্তিরদা। ৮৫-৮৬
বছরেও ছিপছিপে চেহারাটা ধরে রেখেছেন। মাথার চুল গুলো সব
সাদা হয়ে গেছে। চোখে চশমা,
তবে তার ভিতর দিয়ে উঁকি মারছে চিরপরিচিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দুটি চোখ।
নিখুঁত কামানো গালে পড়েছে বলি রেখায় জ্যামিতিক চিত্র। তবে দুটি ভুরু মাঝে যে তিনটি ভাঁজ পড়ত সেটা অবিকল একরকমই আছে। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা।
উল্টো দিকের চেয়ারে বসলেন মিত্তির দা। ভালো করে দেখে নিলে আপাদমস্তক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই
হাজির সেই ছোট্ট মেয়েটি। এক লাফে উঠে বসল দাদুর কোলে।
“আমার নাতনি, ক্লাস থ্রিতে পড়ে”। বলে নাতনির মাথায় হাত বুলতে থাকলেন মিত্তির
দা। টেবিলের উপর একটা কাঁচের অ্যাশ ট্রে, ফাঁকা।
চারমিনারের একটা টুকরোও তাতে নেই। তবে কি মিত্তিরদা.... ভাবতে ভাবতেই প্রেয় অন্তর্যামীর মতো বলে উঠলো মিত্তির দা
“সিগারেট ছেড়েছি বছর পনের আগে। ও বস্তুটিতে মগজ খোলা না বরং মগজের ক্ষতি হয়। একদিনেই ছাড়লাম।অনেক দিনের অভ্যাস জানোই তো। কয়েকটা মাস অসুবিধা হয়েছিল তার পর থেকে সব ঠিক”।
এখন বাড়িতেই থাকেন। মাঝেমাঝে নাতনিকে নিয়ে
সামনের পার্কে হাঁটাহাঁটি। তবে বাড়িতে আমার মতো
ভক্তের ভিড় লেগেই থাকে। অনেকেই মিষ্টি নিয়ে আসেন। কিন্তু মিত্তিরদা চিরকালই খুব অল্প খান।
“রায় বাবু তখন অসুস্থ শেষ কেসটা সমাধান করলাম। তার পর থেকে আর কেস নি না। আর বয়সও তো হোল। বাড়িতে বসে বই পরে আর গান শুনেই সময় কাটে। আর এই নাতনির সঙ্গে খেলাধুলা”।
ভাইপো এখন ব্যবসায়ী। চাকরি ছেড়ে স্বাধীন ব্যবসা করছে। রেস্তরাঁ চেইন-এর মালিক। সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা তো আছেই। বেশ নাম ডাক হয়েছে। এই খবরটা জানাই ছিলো। তাই জানতে চাইলাম-
“গাঙ্গুলি বাবুর খবর কি? তিনি আছেন কেমন?”
“আছে ভালোই আছে। তবে বাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। ডাইবেটিসও আছে। ডাক্তারের বারণ এড়িয়ে এখনও চপ-কাটলেট সাবাড় করে দেয় মাঝেমাঝে। আসলে খেতে এখনও খুবই ভালোবাসে। শুনেছি ভাইপোর রেস্তরাঁতে মাঝে মাঝে অন্য নামে অর্ডার দেয়। ডাক্তারের নির্দেশে অনেক কিছুই বন্ধ। আসতে পারে না। তবে প্রতি হপ্তায় ফোন করে। লেখালিখি খুবই কমিয়ে দিয়েছে। ঐ পূজা সংখ্যার জন্য
যেটুকু লিখতে হয় সেটুকুই লেখে। তবে প্রখর রুদ্রের
বয়স কিন্তু এখন একটুও বাড়েনি ”।
“ দিনকাল কেমন বুঝছেন? খুন জখম তো বেড়েই চলেছে”। সাহস করে প্রশ্ন করে বসলাম।
“দেখো ভাই শুধু খুন হবার পর খুনিকে খুঁজে বার
করাটা গোয়েন্দার কাজ খুন হবার আগে সেটা বন্ধ করাটা কিন্তু
একমাত্র করতে পারে প্রশাসন। আমার আজ আপসোস হয় কাশীর গলিতে যদি বৃদ্ধকে...... যদি খুন হওয়া থেকে বাঁচাতে
পারতাম। মাটির মানুষ ছিলেন.... মনে নেই জয়বাবা.......?”
“বিলক্ষণ মনে আছে। সে কি ভোলা যায়?” কথা লুফে নিয়ে উত্তর দিলাম।
“খুন জখম বেড়েছে, চুরি ছিনতাই বেড়েছে, কিন্তু সেগুলি রুখতে
আর কোনো মিত্তির দার দেখা নেই কেন?” প্রশ্ন শুনে
হালাকা হাসলেন মিত্তির দা।
“রায় বাবু না থাকলে মিত্তির হয় না ভাই! উনি চেহারায় শুধু লম্বা ছিলেন না, মানুষটাও ছিলেন অনেক উঁচু দরের। সেরকম আজকাল আর দেখা
যায় না”। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মিত্তির দা।
“কেন এখন বাঙলায় বুদ্ধিজীবীর ছড়াছড়ি”।
“অর্থনীতি পড়েছ ছোকরা? পড়ে থাকলে চাহিদা আর জোগানের তত্ত্বটা জানো
নিশ্চয়ই। এই ছড়াছড়ি বলেই মাথা বিকবার এতো হুড়োহুড়ি”। কথা বলতে বলতে আবারও চা এসে গেলো। চশমাটা খুলে চায়ে চুমুক
দিয়ে মিত্তিরদা বললেন-
“ভাই ইন্টেলেকচুয়ালরা রাজনীতিকে পথ দেখাবে
তারা রাজনীতিকদের পিছুপিছু কেন হাঁটবেন? বুদ্ধি একটা
আত্মাভিমানের জন্ম দেয়। সেটা খারাপ নয় বরং ভালো। যে মুহূর্তে বুদ্ধির আত্মাভিমান কমে যায় তখন সে দালালে পরিণত হয়”।
“কিন্তু আপনি তো কোন দিন সেভাবে রাজনৈতিক কথা
বলেন নি...তবে আজ হঠাৎ করে?” প্রশ্নটা করেই ফেললাম। মিত্তির দার মুখে এর আগে এই সত্যিই ধরনের কথা শুনিনি।
“কে বলল এই কথা? ভালো করে একবার পড়ে দেখবে গল্পগুলো। রাজনীতি মানে কিন্তু শুধু পলিটিকাল দল গুলোর কাজকর্ম নয়। এর বাইরেও একটা রাজনীতি আছে। এবার সেই রাজনিতীর দিকটায় নজর ফেরান দরকার”। কথা শেষ করে লম্বা চুমুক দিলেন চায়ে।
“রাজ্যের কথা কি বলবেন? কি বুঝছেন পরিস্থিতি?” প্রশ্ন করলাম
“বাঙালির মগজাস্ত্রে জং পরেছে ভাই...আজ থেকে
নয় অনেক দিন থেকেই...ওটাতে জং পড়তে দিও না...” ঘড়ির দিকে তাকালেন মিত্তিরদা। আমায় দেওয়া সময় শেষ
হয়েছে। আমাকেও এবার উঠতে হবে। বিদায় চাইতেই হেসে বললেন
“এখন আমার ভায়োলিন বাজাবার সময়। বুড়ো বয়েসে নাতনির সঙ্গে আমিও শিখছি। জানতো হোমস সাহেবও
শেষ বয়সে ভায়োলিন বাজিয়েই সময় কাটাতেন’।
“তাহলে এখন এই ভাবেই সময় কাটে?”
“বলতে পারো। তবে মনের দরজা জানলা খুলে রেখেছি ,আলোবাতাস যাতে
খেলতে পারে। তোমাদের সিধু জ্যাঠার কথাটা মনে আছে তো...।তিনি বলতেন...মনের জানলা কখন বন্ধ করো
না.....আমি তাই বলি মনের দরজা জানলা দিয়ে একটু হাওয়া রোদ আসতে দাও দেখবে সমস্যা গুলোর
সমাধান নিজেরাই তোমাদের সামনে চলে আসবে। ভালো থেকো সকলে”।
মিত্তিরদা উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে । আমি রজনী সেন রোড ছেড়ে
বেরুচ্ছি কানে এলো ভায়োলিনের শব্দ। মনে পড়ল মিত্তির ঐ
কথাটা “বাঙালির মগজাস্ত্রে জং পরেছে ভাই...আজ থেকে নয় অনেক দিন থেকেই...ওটাতে জং পড়তে
দিও না...”
Arindam