বিকল্প রাজনীতি(১)
ভোটটাই একমাত্র লক্ষ্য বাকি সব উপলক্ষ!
রাজনৈতিক দলের বাইরে রাজনীতি, ভোটের বাইরে রাজনীতির কল্পনা আদৌ বাস্তব হতে পারে কি? ভাবা যেতে পারে কি শুধুমাত্র ‘ভোট ভিত্তিক’ রাজনীতির বাইরে কোন গণতান্ত্রিক রাজনীতির চেহারা ?
অর্থাৎ রাজনীতি বলতেই যে ছবি আমাদের সামনে চলা আসে সেটি ভিন্ন অন্য কোন ধরনের রাজনীতি কি আদৌ সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটা চেষ্টা করা যাক। এই উত্তর আমি একা নয় আসুন সবাই মিলে খুঁজি।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল আমি এখনও এই বিষয়ে কোন সিন্ধান্তে উপনীত হইনি। এই লেখার কারণ আলোচনা টিকে শুরু করা মাত্র। তাই চাইব সবাই মুল্যবান মতামত দিয়ে সাহায্য করবেন। সেই সাহায্যের জন্য সকলের জন্য রইল আগাম শুভেচ্ছা।
শুরুতেই আমারা একবার মনে করে নি ‘রাজনীতি’ শব্দটি বললে এক ঝলকে ঠিক কি ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনের গভীরে।
প্রাথমিক ভাবে চোখ বন্ধ করে ‘রাজনীতি’ শব্দটি শুনলে বেশির ভাগ মানুষের মনেই ভেসে উঠবে লম্বা মিছিল, লাউড স্পিকারে ভোটের প্রচার, নেতাদের সুসজ্জিত ভোট প্রচার, দেওয়ালে ভোট প্রার্থীদের নাম, কিছু প্রতীক চিহ্ন এই সব টুকরো টুকরো ছবি। এরপর আরও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবলে ভেসে উঠবে লোকসভা, বিধানসভা, মন্ত্রীদের মুখ, লাল বাতি লাগান দ্রুত ছুটে চলা গাড়ি।
এর থেকে বেশি সময় চোখ বন্ধ করে ভাবলে ভেসে উঠবে ভোটের নামে বুথ দখল, বোমাবাজি, আর ভোটের পরে শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতির প্রবেশ। জনগণের করের টাকায় ভি আই পি সংস্কৃতি। এই দৃশ্য কল্পনা করে চমকে উঠে চোখ খুলতেই হবে। কিন্তু বাস্তবটা এর থেকে কিছু মাত্র আলাদা নয়। আর এই রুঢ় বাস্তবের পথ ধরেই রাজনীতি প্রতিদিন পরিণত হচ্ছে একটি লাভজনক ব্যবসায়।
এবার যদি ভাবা যায় ‘রাজনীতি’ থেকে আমারা মানে সাধারণ জনগণ ঠিক কি চাই? প্রথম শব্দ যেটা মাথায় আসবে সেটা ‘উন্নয়ন’। কিন্তু প্রশ্ন যদি হয় কে করবে সেই উন্নয়ন? এ আর এমনকি জটিল বিষয়! সহজ উত্তর, কেন রাজনৈতিক নেতারা যারা ভোটে জিতে ক্ষমতায় আছেন। বেশ আপাতত এই টুকুই যথেষ্ট। কারণ আমারা সকলেই বাস্তবটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। সেটা আলোচনা করে সময় নাইবা নষ্ট করলাম।
এতো গেলো আমারা রাজনীতির থেকে কি চাই , কিন্তু রাজনীতি আমাদের কাছ থেকে কাছ থেকে কি চায়? এবার প্রশ্নটা একটু গোলমেলে! কিন্তু উত্তরটা ভাবলেই এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে উত্তর আসবে ‘ভোট’। রাজনীতি জনগণের কাছ থেকে চায় ‘ভোট’, ‘ভোট’ এবং শুধই ‘ভোট’।
অনেকবার চোখ বন্ধ করলেন, এবার চোখ খুলুন। ভেবে দেখলে দেখা যাচ্ছে ঘুরে ফিরে একটাই বিষয়ী সামনে চলে আসছে, সেটা হোল ‘ভোট’। রাজনীতির সঙ্গে জনগণের যোগ সূত্রের এক এবং একমাত্র উপলক্ষ ‘ভোট’। এটা সঠিক কি বেঠিক সেটা পরের প্রশ্ন। কিন্তু বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে জনগণের বড় অংশের যোগসূত্র যে ‘ভোট’ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একটু ভেবে দেখুন, আপনি যদি সক্রিয় রাজনীতি করেন তবে আপনার বেশির ভাগ সময়টা যায় ভোটের প্রস্তুতিতে। একটি নির্বাচন শেষ না হতে হতেই আর একটা নির্বাচন। ভোটের জন্য কি ইস্যু হবে, কিভাবে প্রচার করা হবে, কত চাঁদা তোলা হবে, ভোটার লিস্ট সংশোধন, নতুন নাম তোলা, স্কুটিনি, ভোটের দিন বুথে বসা, গণনার দিন গণনা কেন্দ্রে, তার পর বিজয় মিছিল, বা পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ এবং পরের ভোটের জন্য তৈরি হওয়া। এর মাঝে ভোটের সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসের কথাটা আর নাই বা বললাম। এটা সকলেরই জানা।
এছাড়াও আছে মাঝে মাঝে সভা সমাবেশ করে শক্তি মেপে নেওয়া। আর কিছু দিবস, কয়েকটা রক্তদান শিবির বা পাড়ায় জলসা। এর বাইরে আজকের দিনের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীদের আর কিছু করার সুযোগ আছে কি? কোথায় মানুষের জন্য ভাবনার সময়? কোথায় সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য কাজ করা? কোথায় মানুষের চেতনার উন্নতির জন্য পরিকল্পনা? আর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা বাদই দিলাম। সে নিয়ে ভাবারো সময় নেই। পুরো সময়টাই কাটে ভোট কেন্দ্রিক কাজকর্ম করতে করতে। এর ফাঁকা যারা রাজনীতিকে ব্যবহার করে নিজের আখের গোছাতে চান তাদের কথা না বললেও আমাদের জানা। তারা এই ভোট ভিত্তিক রাজনীতির সুযোগে নিজের আখের গোছাতে থাকেন।
ভারতের যে সংখ্যক লোক প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের একটা অংশ যদি ভোটের বাইরে রাজনীতির যে বিরাট পরিসর আছে তাতে কিছুটা সময় দিতেন তাহলে গণতন্ত্রের চেহারাটা ভিন্ন হতে পারত বলে আমার বিশ্বাস। তবে যে গণতন্ত্র আমারা ভোগ করি সেটা কতটা জনগণের স্বার্থে আর কতটা অল্প কিছু মানুষের স্বার্থে সেই আলোচনার পরে আসা যাবে। বা সেটার আরও বিকাশ হতে পারে কিনা সেই নিয়েও ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
যে বিপুল মানুষ ভারতের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন, অর্থাৎ যাদের আমারা মিছিলে দেখি, যারা ভোট চাইতে আসেন, যারা দলগুলিতে শ্রম এবং সময় দান করেন, তারা প্রায় সকলেই ধরে নেন এই বিষয়গুলি নেতারা ঠিক করে দেবেন। তারা নেতাদের পাঠানো নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যাবেন।
নেতারাও ‘ভোট’ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে তাদের কাছে ভোটটাই এক এবং এক মাত্র লক্ষ্য বাকি সব উপলক্ষ। তাই তাদের বেশির ভাগের কাছেই রাজনীতি মানে ‘ভোট’ আর ক্ষমতায় থাকার পক্রিয়া। ভারতের মূলধারার বামপন্থী দলগুলির কাছে ‘ভোট’ টা প্রাথমিক অবস্থায় উপলক্ষ থাকলেও পরবর্তী সময়ে ‘ভোট’ তাই মুখ্য হয়ে পড়েছে এই কথা বোধ হয় সামান্য রাজনীতি সচেতন মানুষের কেউই আজ অস্বীকার করবেন না।
এর ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার সুযোগ এলেও সামাজিক পরিবর্তনের নিরিখে এবং বামপন্থী ধারার সুফল আনার ক্ষেত্রে ভারতের বামপন্থী দলগুলি সফল নয় তা বলার অবকাশ রাখে না। এর একটা বড় কারণ অবশ্যই ‘ভোট’ রাজনীতিতে তাদের সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হওয়া।
এখন প্রশ্ন বিকল্প রাজনীতি কি হতে পারে? গণতন্ত্রে ভোট ছাড়া সরকার পরিচালনা বাস্তব চিন্তা নয়। সেক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ‘ভোট’ রাজনৈতিক দলগুলির প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বজায় থাকবে। অর্থাৎ জনগণের স্বার্থ সব সময়ই থাকবে উপলক্ষ হয়ে। কারণ আজ একথা আর প্রমাণ করা অপেক্ষা রাখে না যে ভোট ভিত্তিক রাজনীতিতে জনগণ শুধুই উপলক্ষ, ক্ষমতা লাভটাই মুখ্য।
তবে কি হতে পারে বিকল্প রাজনীতি..................... (ক্রমশ)
***পরের অংশে থাকছে - বিকল্প রাজনীতি(২)- দুর্নীতির বীজ কি লুকানো ভোটের বাক্সে??????????
বিকল্প রাজনীতি(২)
দুর্নীতির বীজ কি লুকানো ভোটের বাক্সে?
গত লেখায় বলার চেষ্টা করেছিলাম কি ভাবে ভারতীয় রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ভোট’। যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় প্রবেশ করা। এই ক্ষমতার জন্যেই রিগিং, ভোট লুঠ, খুন জখম থেকে শুরু করে দাঙ্গা, জাতপাতের ইস্যু তৈরি করে ভোট ভিক্ষা, থেকে টাকা দিয়ে ভোট কেনা থেকেই যত রকম সমস্যার শুরু।
ভোটে খরচ করা টাকা তুলতে শুরু দুর্নীতি।দুর্নীতি যদি ভারতের একটি বড় সমস্যা হয় তবে তার বীজ লুকিয়ে রয়েছে ,ব্যাপক অর্থ খরচ করে করা ভোটে। শত শত কোটি অর্থ খরচ না করলে ভোটে জেতা যায় না। অগত্যা হাত পাতা কর্পোরেটদের কাছে। কর্পোরেটরাও এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারাও ঝুলি উজাড় করে অর্থ ঢালে ভোটে। শুধু কর্পোরেট কেন নিন্দুকেরা সন্দেহ করেন বিদেশী শক্তিরও ‘ভোটে’ অর্থ জোগান দেবার সম্ভাবনা খারিজ করে দেওয়া যায় না।
কিন্তু কর্পোরেটরা তো রাজা হরিশ্চন্দ্র নন, তারা ভোটের পরে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব বুঝে নেন। আর তাদের হিসেব বোঝাতে গিয়েই তাদের পছন্দ মতো ‘পলিসি’ আনতে হয় সরকারকে। আর বোঝা চাপে জনগণের ঘাড়ে।
এছাড়াও ভোটে জিতে আসা বেশির ভাগ নেতার পকেট থেকেও অনেক টাকা খরচ হয়। তিনিও সেই টাকা তুলতে তৎপর হবেন সেটা স্বাভাবিক। অগত্যা একটু একটু করে নিতিকে বিসর্জন দেওয়া। আর যেখানে নীতি নেই সেখানে খুব সহজে জায়গা করে নেয় দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতির বোঝা এসে পড়ে গৌরি সেনের ঘাড়ে। মানে জনগণের ঘাড়ে।
জনগণ যে এই সমস্ত কথা বোঝে না তা নয়। তাই যখন তারা দেখেন যে একটি রাজনৈতিক দল দুর্নীতি করছে তখন তারা তাদের সড়িয়ে অন্য দলকে নিয়ে আসে। কিন্তু আসার পদ্ধতিটা সেই একই। অর্থাৎ কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন, নীতি মিলুক বা না মিলুক ক্ষমতায় আসার জন্য আঁতাত, কর্পোরেটদের কাছে হাত পেতে গোপন শর্তে অর্থ গ্রহণ , জাতপাতের ইস্যু, বুথ দখল, দাঙ্গা আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বন্যা।
ফলে আবার সেই কর্পোরেটদের কাছে সমর্পণ, তাদের ইচ্ছায় সরকারে নীতিনির্ধারণ , আবার দুর্নীতি আবর্তে সেই সব কিছু বিসর্জন। যার ফলে মানুষ আগের দলটির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, সেই একই ঘটনা।
এর থেকে মুক্তি কি ভাবে? অবশ্যই এর থেকে মুক্তির রাস্তা আছে। কিন্তু বিকল্প রাস্তাটা বা কি? সেটার কথায় পরে আসছি। সেই মুক্তির রাস্তা খুঁজতে হবে আমাদেরই। সেই বিকল্প রাস্তা খোঁজার কাজটি সম্মিলিত ভাবে চিন্তা করতে হবে।
এই কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যদি ছাঁচ বাঁকা থাকে, তবে সেই ছাঁচে যত বাড়ই সুন্দর ফুলদানি বানাবার চেষ্টা হবে সেটিও বাঁকা হবে। ঠিক সেই ভাবেই ‘ভোট’ আর রাজনীতি সমার্থক হয়ে যাওয়ায় বাররার একই সমস্যা নিয়ে জন্ম নিতে থাকবে নতুন সরকার নতুন প্রশাসনেও। সেখানে কেউ হয়তো বেশি চেষ্টা করছেন প্রশাসনকে দুর্নীতি মুক্ত করার কেউ হয়তো কম। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকার বাধ্যবাধকতার কাছে সকলেই এক প্রকার অসহায় হয়ে পড়ছেন । যুক্তির নিরিখে এর বাইরে কিছু হওয়া সম্ভব নয়।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় দলের নেতা একজন সৎ মানুষ তবুও তার সঙ্গীরা যে সৎ হবেন সেই নিশ্চয়তা কখনই পাওয়া যায় না। তার সঙ্গীরা যে ভোটের আগে অর্থ প্রদানকারিদের কথায় চলবেন না সেকথাও হলফ করে বলা যায় না। তারা যে দুর্নীতির পাঁকে ডুবে পাঁচ বছর সময়কে লুটেপুটে নেবার কথা ভাববেন না সেকথাও কোনো ভাবেই নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না।
আমারা সমসাময়িক ভারতের রাজনৈতিক ঘটনার দিকে যদি লক্ষ্য রাখি তাহলে দেখতে পাবো ভোটের রাজনীতিতে প্রবেশ করে কিভাবে অনেক আশা জাগিয়েও হতাশ করেছে একাধিক রাজনৈতিক দল। আগেই বাম রাজনীতির কথা আলোচনা করেছি। কিভাবে ভারতের বাম রাজনীতি ভোটকে উপলক্ষ থেকে লক্ষে পরিণত করে ধীরেধীরে ভোট কেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে আম আদমি পার্টি-এর কাজকর্মেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ‘পপুলার’ রাজনৈতিক পদক্ষেপের লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে। একটি দলের বিরোধিতা করতে গিয়ে নিতির জোট না করে নিতিশের জোটে তাদের বেশি আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে।
কারণ সেই ক্ষমতায় টিকে থাকার বাধ্যবাধকতা। আর এই বাধ্যবাধকতাই যেকোনো দলকে চিরাচরিত রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে বাধ্য।
তবে সমাধান কোথায়? আদৌ কি এর কোন সমাধান আছে। নাকি শুধুই গোলক ধাঁধার মধ্যে ঘুরে যাওয়া। প্রশ্নের পর প্রশ্ন কিছু উত্তর জানা নেই। না তেমনটা নয় সমাধানের রাস্তা আছে। আর সেই রাস্তা আছে আমাদের সমাজের, আমাদের রাজনীতির মধ্যেই।
সেটা কি ভোট বয়কটের রাজনীতি? না। সেটা কি গণতন্ত্রের বাইরে গিয়ে রাজনীতি? অবশ্যই নয়। সেটা কি গোপন কোন দল? না তাও নয়। তবে কি? কি ভাবে আসতে পারে এই ‘ভিসাস সার্কেল’ থেকে মুক্তি?..........................(ক্রমশ)
******পরের অংশে থাকছে- বিকল্প রাজনীতি(৩) রাজনীতির বাইরেও আছে এক বিরাট রাজনীতি
বিকল্প রাজনীতি(৩)
রাজনীতির বাইরেও আছে এক বিরাট রাজনীতি
রাষ্ট্র বিজ্ঞান আমার ছাত্রবেলার বিষয় নয়। পরবর্তী সময়ে আমি এই বিষয়ে আগ্রহী হই। সেই সুত্রেই অল্প অল্প পড়েছি। এখন পড়ছি। সে যাই হোক রাজনীতির বাইরের রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই মহান দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কথা দিয়েই শুরু করি।
যদিও ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি আজকের রাজনীতির সঙ্গে অ্যারিস্টটলের সংজ্ঞার বিস্তর ফারাক। সেটা খুবই স্বাভাবিক। গ্রীক নগর রাষ্ট্র গুলির বিভিন্ন নীতি এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্রিয়াকর্মকেই অ্যারিস্টটল রাজনীতি বলে তার বিখ্যাত বই ‘পলিটিক্স’ –এ বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হেগ, হ্যারপ এবং বেসলিন যে মতবাদ প্রকাশ করেছেন তার সংক্ষিপ্তসার করলে বলা যায়- তাদের মতে, গোষ্ঠীগুলি যে পক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেটাই রাজনীতি। কিন্তু এটিও বর্তমান রাজনীতির অবস্থা কে ব্যাখ্যা করে না।
আরেক রাষ্ট্রবিঞ্জানী অ্যালান বল রাজনীতি থেকে ‘নৈতিক নির্দেশ’-এর বিষয়টি বাদ দিয়েছেন। তিনি তার ‘মর্ডান পলিটিস্ক অ্যান্ড গবর্মেন্ট’ বলেছেন সমাজের সর্বস্তরের প্রতি বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতিকেই রাজনীতি বলা উচিৎ। এই কথাও কিছুটা আধুনিক রাজনীতির সঙ্গে মিললেও ‘নৈতিক নির্দেশ’ বাদ দিয়ে রাজনীতির ধারণা বাস্তব নয়। কারণ রাজনীতির সঙ্গে সমাজের প্রতিটি অংশ যুক্ত। সেখানে নিতী না থাকলে জনগণের হিতের লক্ষ্যে পৌঁছন অসম্ভব।
এছাড়া মূল্যের বণ্টনের বিষয়টি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করছেন কিছু রাষ্ট্র বিঞ্জানী। এক্ষেত্রে কার্ল মার্ক্সের রাজনীতি সম্পর্কিত ধারনাটি সবথেকে আধুনিক বলে মনে করা হয়। কার্লমার্ক্স রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন শ্রেণী এবং অর্থনীতিকে। লেলিন যেটিকে ‘অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ’ বলে রাজনীতিকে অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছে। যা পুরোপুরি বাস্তব। অর্থনীতিকে বাদ্দিয়ে রাজনীতির কল্পনা পুরোপুরি অবাস্তব।
তবে এই প্রচলিত ধারণা গুলি ছাড়াও আরও কিছু রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা আছে। তবে এই সব কিছু থেকে একটা কথা উপলব্ধি করা যায় যে রাজনীতি দৌন্যন্দিন জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে যুক্ত একটি বিষয়। জীবনের বাইরের কোন ধারণা নয়।
যদি তাই হয় তবে রাজনীতির নামে মধ্যবিত্ত সমাজের নাক সিটকানোর কারণ কি? তার কারণ রাজনীতির এই নগ্ন মারদাঙ্গা, রাজনৈতিকদের দুর্নীতি, সর্বোপরি সমাজের সঙ্গে রাজনীতির দূরত্ব এবং নেতিবাচক সম্পর্ক। এছাড়া আছে এক শ্রেণীর শক্তি যারা বার বার বোঝাতে চেষ্টা করে রাজনীতি প্রাত্যহিক জীবনে কোন কাজে লাগে না। কিত্নু সত্যি এটাই যে রাজনীতিও প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। তাকে কেটে জীবন থেকে বাদ দেওয়া যায় না।
আর এই জোর জুলুম করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেশটার ফলেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে জোর জুলুমের বিষয়টি। তাদের বক্তব্য নীতি সম্প্ররকে না বুঝিয়ে জোর করে সাধারণ মানুষকে তাদের সমর্থক বানাতে সচেষ্ট হয় রাজনৈতিক দলগুলি।
এই জোর কখন গায়ের জোর কখনও বা মিথ্যে প্রতিশ্রুতির জোর, কখন বা আর্থ আর বিজ্ঞাপনের জোর। এটা শুধুমাত্র ভারতের নয় গোটা বিশ্বের বড় অংশের চিত্র। কিন্তু কোথায় জনগণ তাদের একাত্মতা খ৬জে পায় রাজনীতির সঙ্গে? কোন জায়গায় তাদের ভালো থাকা,মন্দ থাকা নির্ধারিত হয় তাদের রাজনীতি সচেতন হবার উপরে?
এই জায়গাটি ভোট কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলি প্রকাশ্যে আনতে চায় না। রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক দলের কাজ কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং সমাজের বৃহত্তর রাজনীতি আছে রাজনৈতিক দলগুলির কাজকর্মের বাইরে।
অর্থাৎ ‘ভোট’ এর বাইরে আছে বৃহত্তর রাজনীতি যা অর্থনৈতিক বিষয় পরিচালনা, সমাজ , সংস্কৃতি, দৈনন্দিন জীবন যাপন , মতাদর্শ, পরিবার সবকিছুর উপুরেই প্রভাব বিস্তার করে। তাই রাজনীতি শুধু ‘ভোট’ নয়। রাজনীতি শুধু একে অপরের সমালোচনা নয়, রাজনীতি কিছু ধান্দাবাজ নেতা আর তার প্রসাদ পাওয়া দলিয় কর্মীরা নয় রাজনীতি সভ্য সমাজের জীবনের একটি অঙ্গ।
কিন্তু সামাজিক ‘সিস্টেম’ –এ খুব পরিকল্পিত ভাবে বোঝান হয় রাজনীতি কিছু বিশেষ মানুষের বিষয়। যিনি একটি কারখানা চালাতে পারেন, যিনি একটি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতে পারেন অথবা যিনি একটি পরিবারকে পরিচালনা করতে পারেন তিনি কেন তার জীবনের, তার দেশের, তার সহ নাগরিকদের ভালো মন্দের দায়িত্ব, তার অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন হবেন না?
জনগণের বড় অংশ সচেতন নয় বলেই আজ রাজনীতি সাধারণ মানুষের থেকে অনেক দূরে। কিছু মানুষের মুঠোয় বন্দি। এখানে প্লেটোর একটি কথা স্মরণ করা যায়, "One of the penalties for refusing to participate in politics is that you end up being governed by your inferiors." অর্থাৎ হয় তুমি রাজনীতিতে এসে রাজনীতিকে পাল্টাও অথবা কোনো নিম্ন মেধারর মানুষের দ্বারা পরিচালিত হও।?..........................(ক্রমশ)
******পরের অংশে থাকছে- পালটাতে তো চাই কিন্তু বিকল্পটা কি?
পালটাতে তো চাই কিন্তু বিকল্পটা কি?
বিকল্প অনেকগুলি হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে এই মহুর্তে যেটি সবথেকে দরকারি বলে মনে হচ্ছে সেটি হোল এমন একটি বা একাধিক রাজনৈতিক দল যেটি সরাসরি ভোটে অংশ গ্রহণ করবে না করবে না। কিন্তু সে গণতন্ত্রে অবশ্যই বিশ্বাসী হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলেই সেই দলকে ভোটে লড়াই করতে হবে তার কোনো প্রাথমিক শর্ত নেই।
গণতন্ত্রে বিশ্বাসের পূর্ব শর্ত কখনই ভোটে বাধ্যতা মূলক অংশগ্রহণের বিষয় হতে পারে না। ‘না ভোট’ বা নোটা-এর সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের স্বীকৃতি এই ধারণাকেই পুষ্ট করে। সেক্ষেত্রে এমন এক বা একাধিক দল গঠন হতেই পারে যারা ভোটে অংশ না নিয়েও মানুষের দাবি নিয়ে কথা বলবে। দেশ চালনার বিষয়ে জনগণের মতকে প্রশাসনের কাছে তুলে ধরবে।
এর ফলে গণতন্ত্রে ভিত আরও সুদৃঢ় হবে । জনগণের বেশি মাত্রায় দেশ পরিচালনার কাজে যোগ সূত্র তৈরি হবে।এর ফলে জনগণের ইচ্ছা বেশি প্রাধান্য পাবে। আর যেটা কমবে সেটা হোল মতামত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।
ভোট ভিত্তিক রাজনীতি না হলে ক্ষমতায় টিকে থাকার বাধ্যবাধকতাও থাকছে না। থাকছে না দুর্নীতির সুযোগও। ভারতের মূল সমস্যার একটি এই ভাবে সমাধান করা যেতে পারে।
ভোট নেই তাই দল বাড়াবার কোন দায়ও থাকবে না এই দলগুলির। তাই সোজা কথাটা সোজা ভাবে বলার ক্ষমতা থাকবে । চিরাচরিত রাজনীতির মধ্যে জনগণের ‘ফিলটার’ হিসেবে কাজ করতে পারবে এই দলগুলি।
এই প্রসঙ্গে কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন তাহলে যে গন সংগঠন গুলি বা এন জি ও গুলি আছে তাদের সঙ্গে এই ভোটে অংশ গ্রহণ না করা রাজনৈতিক দলগুলির পার্থক্য কি? এটা কি নতুন বোতলে পুরানো মদের ধারণা হয়ে গেল না?
না মূল পার্থক্য টা ‘দৃষ্টিভঙ্গি’-তে। একটি সংগঠন কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় এবং কাজকর্ম পরিচালনা করে সামগ্রিক ক্ষেত্রে একটি সংগঠনের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া বেশির ভাগ সংগঠন একটি ইস্যু ভিত্তিক হওয়ায় তাদের অনেক সময়য়ই রাজনৈতিক কোনো মতাদর্শ বা লক্ষ্য থাকেনা।
এই জন্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাই এক বা একাধিক এই ধরনের দল। এই ধনের দল যত বেশি করে তৈরি হতে থাকবে তত বেশি করে ভোটে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলি তাদের শুধু মাত্র ভোট ভিত্তিক রাজনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। ফলে গণতন্ত্র মানুষের পক্ষে থাকবে, কোন বিশেষ শক্তির পক্ষে নয়।
সুনিশ্চিত হবে মানুষের অধিকার। আর এটাই আজকের দিনের বিকল্প রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে। অতএব এখানেই শেষ নয়। এটা শুরু , সময়ের সাথে সাথে বদল হবে বিকল্প রাজনীতির গতি প্রকৃতি। আপাতত এখন এই নিয়ে চিন্তাটা শুরু করা দরকার। সকলের মতামত চাইছি।
অরিন্দম চ্যাটার্জি।