তিনি বৃদ্ধ হলেন... AKM স্যার হাজির হলেন অন্যভাবে

তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। লম্বা, শিরদাঁড়া সোজা করে চলা মানুষটা বয়েসের ভারে একটু ঝুঁকে আছেন। ফিটফাট কটন ট্রাউজারর আর হাফ হাতা চেক শার্টের পকেটে রাখা একটি পেন। আজও হাফ সার্ট তবে সেটাও বয়েসের ভারে কিছুটা অবিন্যস্ত।
তিনি অবসর নিয়েছেন । অবসর নেয়নি তার ভিতরের শিক্ষক। তাই ছাত্রদের ছবি দেখে চেষ্টা করেন আজও ছোট ছোট ছেলে গুলোর মুখগুলোকে মনে করার। কিন্তু হাজার হাজার মুখের ভিড়ে সবাইকেই কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়। চোখের চশমায় পাওয়ার বেড়েছে কমেছে কানের ক্ষমতা। এক সঙ্গে ইংরেজি আর রসায়ন পরানোর বিরল কৃতিত্বের অধিকারী শিক্ষক আজ বৃদ্ধ হয়েছেন।
এহেন প্রিয় শিক্ষক আবার হাজির হলেন প্রায় ২০ টি বছর পর। সময়টা ১৯৯৬ সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তার পা ছুঁয়ে স্কুল গেট পেরিয়ে ছিলাম। তখন তো বুঝিনি আসলে যে গেট পেরচ্ছি সেই গেটের ভিতর রেখে যাচ্ছি আমার জীবনের সব থেকে দামি সময়টিকে। তা হলে হয়তো আরও ধীরে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে স্কুল গেটের বাইরে পা রাখতাম।
কিন্তু সেদিন তাড়াহুড়ো ছিল। বড় হবার তাড়াহুড়ো। তখন একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী কলেজে পরা যেত। সেদিন কলেজে ভর্তি হবার আগ্রহে একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে এসেছিলাম আমার ছেলে বেলাকে ফেলে। শেষ বারের মতো স্কুলের মাঠে গিয়েছিলাম। আমি আর দেবরাজ চন্দ্র। ভালো করে দেখেছিলাম স্কুল বাড়িটাকে।
কথায় বলে বয়স বাড়লে বাড়ে মায়ার বাঁধান। কিন্তু কেন জানি সেই ছোট বয়েসেই শেষ বারের মতো ছাত্র হিসেবে বেড়িয়ে আসার সময় কান্না পেয়েছিল। গেট পার হলাম পা দিলাম এক নতুন জীবনে। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হয়ে গেলাম।
কথায় বলে ঢেঁকি সর্গে গিয়েও ধান ভাঙে। আমার হয়েছে তেমন অবস্থা। কথা হচ্ছিল ২০ বছর বাদে AKM স্যারকে অন্যভাবে খুঁজে পাওয়ার আর আমি জিয়াকে করে ফেলছি নস্টাল। পাঠক বিরক্ত হলে একান্ত ভাবে ক্ষমা প্রার্থী। তবে আমার এই ব্যক্তিগত আবোলতাবোল জার্নাল বন্ধুরা আর পরিচিতরা ছাড়া বিশেষ কেউ পরে বলে মনে হয় না। আশা তারা এটিকে লঘু দোষ বলে মাফ করে দেবেন।
১৯৯৬ থেকে সরাসরি চলে আসি ২০০৮ সালে। স্কুল কলেজ পেরিয়ে আমারা তখন যে যার পেশায় প্রবেশ করেছি। পূজার সময় আমারা কজন হাজির হলাম স্কুলে। পূজার সময়। তখন স্কুল ছুটি। যিনি তৎকালীন দারোয়ান তিনি তার কর্তব্যের খাতিরে আমাদের কোন ভাবেই ঢোকার অনুমতি দেবেন না। আমাদের অতি পরিচিত ‘তোপে’-দা তখন স্কুলে নেই। নেই বালেশ্বর দাও। থাকলেও ঢুকতে দিতেন কিনা সন্দেহ। এদিকে আমারাও নাছোড়বান্দা।
আনন্দশংকর  বিদেশ থেকে এসেছে, আমারা এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম, কোন ঘর খুলে দিতে হবে না একবার ঢুকেই বেড়িয়ে আসব ইত্যাদি কথায় দারোয়ান ভদ্রলোকের মনে বোধহয় একটু দয়া জন্মে ছিল। তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। (স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ, এই ঘটনার জন্য দয়া করে ঐ নরম হৃদয় মানুষটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন না। এর সমস্ত দায় আমাদের।)
ক্যামেরা ছিল আনন্দশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। গোটা স্কুল ঘুরে। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আমাদের ক্লাস ঘর গুলির দিকে উঁকিঝুঁকি মেরে , করিডোরে রাখা বেঞ্চের উপর বসে আমি , কৌশিক, অরিন্দম দত্ত আর আনন্দ বেশ কিছু ছবি তুলে ফিরে এলাম। পাঁচ মিনিট নয় আমারা স্কুলের ভিতরে ছিলাম প্রায় ৩০ মিনিট।
এবার ২০০৮ থেকে ২০১২ সালে। অর্কুট তখন চলছে নেট দুনিয়ায়। শিশু ফেসবুক তার সঙ্গে সবে পাল্লা দিচ্ছে। যে ছবি গুলো অর্কুটে ছিল আনন্দ সেগুলিকে ফেসবুকে পোস্ত করল। আমারা সবাই শেয়ার করলাম। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে এক অদ্ভুত ঘটনা। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাস ,ফেসবুকে মেমরি হিসেবে ভেসে উঠল স্কুল গেটের সামনের তোলা আমাদের একটি ছবি।  আমরা শেয়ার করলাম , মন্তব্য করলাম। ভালো নামের নিচে লিখে দিলাম আমাদের ‘কোড’ নাম গুলি।
কিছু এখানে অদ্ভুত কিছু নেই। হঠাৎ একটি ‘মেসেজ’ আমাকে বেশ অবাক করলো। একটি মেয়ে ফেসবুকে জানতে চাইলো আমি নিউআলিপুর মালটিপারপাসের ছাত্র ছিলাম কিনা। আশ্চর্য! বেশ অবাক হলাম। ভেবে দেখলাম কোন ভাবেই মেয়েটি চেনা নয়। তবে কি কারণে তার এই উৎসাহ? ভাবনা চিন্তা করে কিছু বুঝতে না পেরে জানালাম ‘হ্যাঁ’।
এবার আমার দ্বিগুণ অবাক হওয়ার পালা। মেয়েটি ফিরতি ‘মেসেজ’-এ জানাল ‘ দাদা, আমার বাবা ঐ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন’।
‘আমাদের স্কুলের শিক্ষক!’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
“হ্যাঁ-অজয় কুমার মুখার্জি-AKM স্যার”

“AKM- স্যার! তুমি স্যারের মেয়ে!” অচেনা মেয়েটি এক ঝটকায় অনেক দিনের চেনা মনে হোল। গুরু কন্যা তো পরিচিত হবারই কথা। গুরু কন্যার নাম অহনা। ছবি চাইলাম স্যারের। পরের দিন ছবি এসে গেল আমার ফেসবুকে। তার মধ্যেই স্যার কন্যার মাধ্যমে আমাদের  ছবি দেখেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই চিনতে পারেননি। শুধু বলেছেন আনন্দর মুখটা চেনা চেনা লাগছে। কি করে চিনবেন স্যার। তখন ১৬ আর এখন ৩৬। মধ্য তিরিশ পার করে দিয়েছি। মোটা হয়েছি কিছুটা। মাথার চুল পাতলা হয়েছে। একটা দুটোতে পাকও ধরেছে। আমারাও বুড়ো হচ্ছি স্যার।
আর যত বুড়ো হচ্ছি তত আপনাদের কথা বেশি করে মনে পরে। প্রতি দিন, জীবনের প্রতিটি বাঁকে আপনাদের  কথাগুলো ‘গুরু মন্ত্রের’ মত আজ কানে আসে। বাঙলা মিডিয়ামের ছাত্র তবুও যখন সায়েব সুবোদের সঙ্গে কথা বলি, বা সাহস করে ইংরেজি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি বারবার মনে হয় আপনি বলতেন ‘প্রিপজিশান’ টা ঠিক থাক বসানো খুব জরুরি।'
মনে মনে ভাবি একদিকে রসায়নের মত বিষয় অন্য দিকে ইংরেজি পড়ানো, বিঞ্জান আর সাহিত্য এসে কি ভাবে মিলতও একটি বিন্দুতে। এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি। শিখতে হবে ঐ অগাধ পাণ্ডিত্য নিয়েও কি করে এতটা নিরহংকার থাকতেন, শিখতে হবে আমাদের মতো পাজিদের এত ঠাণ্ডা মাথায় কি ভাবে সামলাতেন। শুনলাম আপনার শোনার ক্ষেত্রে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। বলার ক্ষেত্রে তো সমস্যা নেই স্যার।
তাহলে একটা ক্লাস করার না। সেখান না কি ভাবে আপনার মতো মানুষ হওয়া যায়। ব্লাক বোর্ড বেঞ্চ নাই বা থাকলো। আপনি খাটে বসবেন আর আমারা মাটিতে। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন। প্রণাম নেবেন।

ছবিঃ অহনা এবং ফেসবুকের বন্ধুদের থেকে নেওয়া
Arindam