এটা আমার 'স্কুল বেলার' গল্প। এই গল্পের শুরু ক্লাসে, বলা ভাল গল্প বলার ক্লাসে। অনেক কিছুর মতোই মগজের এককোণে কিছুটা ধূসর আবার কিছুটা স্পষ্ট আমার এই গল্পের
ক্লাস। যতদূর মনে পরে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এটি স্কুলের রুটিনে সপ্তাহের একটি পিরিয়ড বরাদ্দ থাকত। ৪৫ মিনিট সময়। সেখানে কখন কোন শিক্ষিকা আবার অনেক সময় কোন ছাত্র একটি
করে গল্প বলতো। শিক্ষিকা কথাটা আজও আমার কাছে কেন জানি না বেশ গুরুগম্ভীর মনে হয়। আমারা শিক্ষিকাদের বলতাম 'আন্টি'। কেউ কেউ ‘দিদিমনি’ বলত।
এই 'আন্টি' শব্দটা যেন
একেটু বেশি কাছের। বেশি আপন। আজ এই 'আন্টি' ডাকটা শুনলে আমার যাদের ছবি গুলো ভেসে আসে তারা বেশ
কয়েকজন আজ জীবনের ছোট্ট সীমা পেড়িয়ে অমর হয়ে গেছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম আমার স্মৃতি।
স্কুল থেকে পাশ করে বেড়িয়ে আর কাউকে 'আন্টি। বলে সম্বোধন করিনি। অন্যদের 'কাকিমা', 'মাসিমা' এইসব বলেই চালিয়ে দিলাম।
না 'আন্টি'দের কথা বলবো অন্য একদিন। সাত বছর প্রাতঃকালীন বিভাগের স্মৃতি নিয়ে প্রতিদিন
একটি গল্প লেখা যেতে পারে। তবে আমার এই আন্টিদের ভালবাসার সঙ্গে মায়ের ভালবাসার সত্যিই
কোন তফাত পাই না। যে কথা বলছিলাম, আমাদের সেই গল্পের ক্লাস। শুরুর দিকটায় 'আন্টি'-রা গল্প বলতেন। কি গল্প বলতেন সেটা ঠিক মনে নেই। আসলে তখনও তো ভাবিনি বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে রাখবে আমার ফেলে আসা স্কুলের দিন গুলো। তা হলে হয়তো লিখে রাখতাম কোন ডাইরিতে। কে জানত ঐ বছর গুলিই হয়ে উঠবে আমার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ
সময়!
তবে এটা বেশ মনে আছে, আমারা মন দিয়ে শুনতাম সেই গল্পগুলো। তবে সবাই যে গল্পের প্রতি পুরোপুরি মন দিত তেমনটা কিন্তু নয়। শুভাশিস কে মনে আছে।শুভাশিস চক্রবর্তী। আমার পাশে বসত। আর ঐ গল্পের ক্লাসেই ওর মাথায় আসত যত দুষ্টুমি
বুদ্ধি। এখন ভাবলে বেশ মজা লাগে। সুরোজিত তরফদার। মাঝে মাঝেই গল্পের ক্লাসে একেকটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসত। স্কুলের পর সুরজিতের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। জানি না কোনদিন দেখা হবে কিনা! ওর সবুজ সোয়েটার আর 'স্কুল ড্রেস' পরা ছবিটাই আমার মগজে গাঁথা হয়ে আছে।
এখন মনে হয় ওর সঙ্গে
মিল আছে সুকুমার রায়ের লেখা দাশুর। দুষ্টু ,তবে তার মধ্যে একটা ‘প্রলেতারিয়েত’ চরিত্র। প্রতিবাদী, কিছুটা বিদ্রোহী। তবে এটা আমার একেবারে নিজস্ব বিশ্লেষণ। জানি না সুরজিত আজও সেই
রকমই আছে কিনা। ভাবছেন গল্প বলার ক্লাসে আবার কিভাবে হাজির হল রাজনীতি! কথায় আছে না 'ঢেঁকি সর্গে গেলেন ধান ভাঙে’। আসলে রাজনীতি আমার অন্যতম প্রিয় বিষয় বলেই আমি শেষ পর্যন্ত কোন
দলের সমর্থক থাকতে পারলাম না। তাই দলছুট জীবনটাকেই বেছে নিলাম।
তবে বৃহত্তর রাজনীতির
শিক্ষা কিন্তু দিয়েছিল আমার গল্প বলার ক্লাস। তখন থেকেই মাথার মধ্যে কি ভাবে যেন ঢুকে গিয়েছিল ঈশ্বর মানে তো একজনই
তিনি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।
আন্টিরা গল্প বলার
ক্লাসে বিদ্যাসাগরের বেশ কিছু গল্প বলতেন। এটা মনে আছে। আর আমি সেই গল্পের সঙ্গে কিভাবে যেন নিজেকে মিশিয়ে ফেলতাম।
ঠিক যেমন আজকের ছোটরা কার্টুন চরিত্র
গুলির সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে ফেলে। জানিনা আমার মতো তাদেরও কখোও কখনও নেতাজী
সুভাষ, কখন ক্ষুদিরাম আবার কখন নিতীনিষ্ঠ রাজা বিক্রমাদিত্য হবার ইচ্ছা জাগে কিনা। তবে শুধু এরাই নন। তখন সচিন মাঠে নামেননি। তবে গাভাস্কার ছিলেন, স্রীকান্ত, রবি শাস্ত্রী,দিলীপ বেংসকার, কপিল দেব ছিলেন। আর ছিলেন কৃশানু-বিকাশ আর ইস্টবেঙ্গলের গোলে ভাস্কর গাঙ্গুলি।
আমার বন্ধু গৌতম সরকার। গৌতম ছিল পাক্কা মোহোনবাগান। অরিজিতও তাই। আর আমরা ছিলাম ইস্টবেঙ্গল। সেটাও আরকেটা গল্প। পরে বলব। ফিরে আসি গল্পের ক্লাসে।
আমার বন্ধু গৌতম সরকার। গৌতম ছিল পাক্কা মোহোনবাগান। অরিজিতও তাই। আর আমরা ছিলাম ইস্টবেঙ্গল। সেটাও আরকেটা গল্প। পরে বলব। ফিরে আসি গল্পের ক্লাসে।
শুধু আন্টিরা বলতেন তাই নয় কখন কখনও আমারাও বলতাম। আমাদের মধ্যে বেশি বলত আনন্দ। আজকের ড. আনন্দশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। পোলিও মুক্ত ভারত গড়ার কাজে যার আন্তরিক অবদান আছে। যতদূর জানি পোলিও মুক্ত বিশ্ব গড়ার কাজে সে এখন ব্রতী হয়েছে। আবাছা হলেও মনে আছে সৌমিক মুখার্জির কথা। সৌমিক মাঝে মাঝে গল্প বলত। খুব মনে পড়ে সৌরভ দে-এর কথা।
মস্তিষ্কের স্মৃতির দরজা গুলোতে করা নাড়লেই মনে পড়ে সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা হাফ সার্ট
পরে গল্প বলছে কখনও সৌরভ কখনও সৌমিক কখন আনন্দ বা অন্য কেউ। একবার দুবার হয়তো আমিও। পিছনে 'ব্ল্যাক বোর্ড'। পাশে আন্টিদের চেয়ার। জানলা দিয়ে চোখ মেললেই দুর্গাপুর ব্রিজ তারপর খোলা আকাশ।
আর সেই আকাশেই গল্পের
চরিত্ররা মেঘ সেজে উঁকি দিত। আজও উঁকি দেয় আমার ছাদের ঘরের জানলা দিয়ে।
ঠিক সেদিনের মতই নীতি
মালা নিয়ে হাজির হয় আজও যখনই কথা মনে
পড়ে। আসলে গল্পরা তো আমাদের মধ্যে চেতনার জন্ম দেয়, ছোট থেকে বড় করে। আমার স্কুল বেলার গল্পের
ক্লাস আজও আমাকে গল্প বলে। জীবনের গল্প,সবাই মিলে বেঁচে থাকার গল্প, নিজেদেরকে বাঁচিয়ে
রাখার গল্প। জানিনা আজও সেই
গল্প বলার ক্লাস রুটিনে আছে কিনা! যদি থাকে আবার হয়তো অন্য কোন কলম লিখবে সেই
গল্পবলার ক্লাসের গল্প।
অরিন্দম