আমাদের চার তলার ঘর গুলি

আবার স্কুল বেলার গল্পআবার স্মৃতির সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া পালাআবার মন ভাল করার টনিক। আবার খুশির কাপে কয়েক চুমুকএবার সোজা চারতলার ঘরেযে ঘর গুলো দৈবাৎ খোলা হলেও বেশির ভাগ সময় তালা বন্ধ থাকতকেন বন্ধ থাকত সেটা আমার জানা ছিল নাসম্ভবত প্রয়োজন পড়তো না বলেই ঘর গুলিকে বন্ধ রাখা হোতোআর আমাদের একটা অদম্য আগ্রহ ছিল এই চারতলা নিয়ে

যারা এই চারতলার ঘর গুলির বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে একবার না একবার  উঁকি মেরেছ তারা বুতে পেরে গেছে আমি কিসের কথা বলতে চলেছি কারণ তাদেরও নিজের নিজের গল্প আছে এই চারতলার ঘর গুলিকে ঘিরে।

তবে যারা ঐ দরজায় উঁকি মারেননি তাদের জন্য খোলসা করে বলিযে চারতলার গল্প বলতে বসেছি সেটা আমাদের স্কুল বাড়ির মনে পড়ে তিনতলা পর্যন্ত সব ঘরেই ক্লাস হোতোচারতলায় ছিল লাইব্রেরি রুমতার পাশে লম্বা বারন্দা আর বারন্দার একধারে পরপর দরজায় তালা ঝোলানমাঝেমাঝে আমারা টিফিনের সময় চারতলায় যেতামচার তলার সামনের দিকের করিডর থেকে নীচের দিকে তাকালে লুঙ্গি আর খাঁকি জামা পড়া ঝালমুড়ি দাদুকে দেখা যেততার পাশেই আচার ইত্যাদি নিয়ে বসতেন আরও একজনছেলেরা ছোট গেটের মধ্যে দিয়ে কখন বা বড় গেটের ফাঁক দিয়ে আচার ঝালমুড়ি  কিনতছোট গেট আর বড় গেট যারা বুঝতে পারলেন না তাদের জন্য বলা দরকারমেইন গেটের মধ্যে একটি করে লোকজন বেরবার গেট থাকেআমার ঐ গেটটাকেই বলতাম ছোট গেটআমার চার তলার উপর থেকে দেখতে বেশ মজা লাগতসোজা তাকালেই দুর্গাপুর ব্রিজ, চেতলা যাবার রাস্তাতবে তখন ব্রিজের চেহারায় আজকের আভিজাত্য ছিলনা
ছবি আনন্দ শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে ফেসবুক থেকে নেওয়া

বারন্দার উল্টো দিকে গেলেই দেখা যেত স্কুলের মাঠের সেই রবার গাছটাকেযেটা আমাদের সঙ্গেই বড় হচ্ছিলকিন্তু তখনও চারতলা ছাড়াতে পারেনিগাছে নতুন পাতাগুলো খানিকটা লাল রঙের শঙ্কুর মত হয়ে থাকত

আর একদম শেষ অংশ থেকে দেখা যেত দরোয়ান তোপেদার ঘরএকটা কথা আমার তখন খুব মনে হ এখনও মনে হয়স্কুলে এত ঘর থাকতে কেন তোপে ডাকে ঐ রকম একটা ছোট ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিলনিয়ম নাস্তি! হয়ত সেই জন্যই

আরও একটা মজার জিনিষ ছিল এই চারতলায়নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস স্কুলের পাশেই নিউ আলিপুর কলেজতখন সদ্য দিবা বিভাগে মানে 'ডে সেকসান'-এ উঠেছিটিফিন ক্লাসে চারতলার সামনের দিকের করিডোর দিয়ে দেখতাম কলেজের দাদারা চলেছে যে যার হিরোর স্টাইলেতখন আমি মাছ বাছার মত করে সিনেমা দেখা শুরু করেনিতবে হিন্দি সিনেমার প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ততোদিনেতাই ঐ কলেজের দাদাদের দেখতে বেশ মজা লাগতকেউ প্রশ্ন করতেই পারেন শুধুই কি দাদাদের? নিউ আলিপুর কলেজে দিদিরাও পড়ত!

সত্যি কথা বলতে কি আমার মত ভিতু টাইপের ছাত্রের পক্ষে দিদিদের স্টাইলের দিকে নজর দেবার সাহস খুব একটা ছিলনাশেষের দিকে কেউকেউ যে দিদিদের প্রতি নজরদারি করত  না সেটা হলফ করে বলা যাবে নাএবং সেই কেউ কেউ-দের আলোচনার মধ্যে আমিও কয়েকবার আগ্রহ নিয়ে অংশ নিয়েছি এটাও সত্যি

যাই হোক ভয়ের কথা যখন উঠলই তখন আবার ফিরে  যাওয়া যাক আরও একটু ছোট বেলায়প্রাতঃকালিন বিভাগ মানে 'মর্নিং সেকসান'-এ চারতলা নিয়ে একটা ভয়ও কাজ করতভুতের ভয়! কেউ কেউ হাসতেই পারেন , ঘোর নাস্তিকের আবার ভুতের ভয়! এটা কেমন কথাতাদের জন্য বলি, আমি  নাস্তিক হলেও একটা সময় পর্যন্ত সত্যিই ভুতে য় পেতামপরীক্ষা দেবার আগে না হলেও ফল বেরোনোর সময় হাত জোর করে  বালক ,লোক প্রভৃতির ছবিতে মাথা ঠুকতাম। বেশ কিছুদিন পরে বুঝেছি বালক হোক বা লোক আর নাথ হোক বা ব্রহ্মচারী কারোর ক্ষমতা নেই আমার রেজাল্টটাকে ভাল করে দেবারযা করতে হবে সেটা আমাকেই করতে হবেযাই হোক এখানে আমার নাস্তিক হয়ে ওঠার গল্প বলব না

তখন মর্নিং সেকসানে পড়ি, কি ভাবে যেন রটে গিয়েছিল চারতলায় ভুত আছেবেশ একটা গা ছমছমে ভাবক্লাসের ছেলেদের কেউ কেউ সেটা পাত্তা দিচ্ছে আবার কে দিচ্ছেনাবে বর্তমানের এই নাস্তিক কলমচি কিন্তু ভয় পেয়েছিল এটা একশ ভাগ  সত্যিতবে ভয় কেটেও গিয়েছিল কিছু দিন বাদেএখন বুতে পারি চারতলার ঘর গুলি সম্পর্কে আগ্রহের একটা কারণ ছিল সেই ভয়

তবে চারতলা ছিল আমাদের দুষ্টুমির জায়গাকারণ শিক্ষক- শিক্ষকরাও খুব একটা আসতেন নাএকবার প্রয়াত এস এম স্যার খুব রেগে ক্লাসে ঢুকলেনকে নাকি চারতলা থেকে উল্টো দিকের বাড়ির............... সেসব থাক আসলে ওগুলো ছিল নিষ্পাপ দুষ্টুমিএখন চাইলেও করতে পারব না।  কে সেই দুষ্টুমিটা করেছিল ?জানি। কিন্তু সেদিনও তার নাম আমারা কেউ বলিনি আজও বলব না। আর এই ভয় , দুষ্টুমি আর ভালবাসা নিয়েই ছিল আমার চার তলার ঘরগুলিযেখানে আজও আমি দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারিতবে স্বপ্নে

  অরিন্দম