ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান এবং আমার স্কুলবেলা
সদ্য শেষ হয়েছে কলকাতা ফুটবল লিগ। লীগের শেষ বড় ম্যাচ ছিল ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের। আজকাল বড় দলের খেলাগুলিকে ‘ডার্বি’ বলা হচ্ছে। আগে রেসের মাঠে ‘ডার্বি’ শব্দটার খুব চলছিল। এখন ফুটবল মাঠে এই শব্দটা বেশ চালু। বিদেশের মাঠেও বড় ম্যাচগুলিকে ‘ডার্বি’ বলাহয়।
খেলা  হল তার ফলাফলও এলো, তার সঙ্গে বাড়তি এলো বেশ কিছুটা উত্তেজনা। চিরন্তন সেই উত্তেজনা! যা ইলিশ বনাম চিংড়ি দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় দেশ ভাগ, উদ্বাস্তু , ঘটি বাঙালের লড়াই দিয়ে। এই লড়াই চলছে চলবে।
এরই ফাঁকে আরও একটা ঘটনা ঘটে গেল। কলকাতার ঘটি-বাঙালের লড়াইয়ের মাঝে যে খবর নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পাননি ফুটবল প্রেমীরা। অন্তত কলকাতার ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের সমর্থকরা। এই চোখে না পরা খবরটি হোল এই সময়েই যোগ্যতা নির্ধারণ ম্যাচে হেরে আবার বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন পর্ব থেকে বিদায় নিলো ভারত।
এটা অবশ্য বড় খবর নয়, কারণ এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু হলে তখন সেটা খবর হয়। সে যাই হোক ভারত   নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বকাপ খেলবে এটা জেগে জেগে কল্পনা করা কষ্টসাধ্য। তবে এর জন্য ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের লড়াইটা কিন্তু থেমে নেই। থেমে নেই ঘটি-বাঙালের মিষ্টি ঝগড়া।
এই লড়াইয়ের যত্ন করে জমিয়ে রাখা স্মৃতি আছে আমার ঝুলিতেও। তখন ক্লাস সেভেন কি এইট হবে। সেই সময় আমাদের ক্লাসে আড়াআড়ি দুটো দল হয়ে যায়। একটা যারা ইস্টবেঙ্গলকে সমর্থন করে আরেক দল মোহনবাগান।
আর এই দুই দলে ‘বড় ম্যাচ’ নিয়ে চলত  তীব্র বিতর্ক। ‘তীব্র’ শব্দটিকে যতটা তীব্র ভাবে উচ্চারণ করায়ায় আমাদের বিতর্কটা ছিল ততটাই তীব্র। এই দুই ভাগের মধ্য স্পষ্ট মনে আছে গৌতম সরকার আর অরিজিত দাসকে। এরা ছিল আমাদের বিপক্ষে। মানে মোহনবাগানের দলে। আরও অনেকে ছিল। বেশ ভারি দল ছিল মোহনবাগানের। তবে বাঙালদের দলও কম ছিল না।
ওদিকে তখন শিশির ঘোষ এদিকে তখন কৃশানু-বিকাশের যুগ। সঙ্গে ছিলেন চিমা ওকেরির মত স্টাইকার। এখনও মনে আছে সেই সময়ও দেশি-বিদেশী খেলোয়াড় নিয়ে তর্কটাও ছিল। আজ আর বিদেশী খেলোয়াড় নিয়ে ছুতমার্গ নেই। এখন বিদেশীরাই এই দুই ক্লাবের তারকা খেলোয়াড়।
আমাদের দলে আমি ছিলাম তার্কিকদের মধ্যে একজন। যেদিন খেলা থাকতো সেদিন টিফিনের তর্ক যুদ্ধ মল্ল যুদ্ধের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে যেত। তবে এই কথা হলফ করে বলতে পারি এই নিয়ে মারামারি  কোন দিনও হয়নি।
আমাদের মধ্যে ভালো ফুটবল খেলত শান্তনু রায়, মানে আমাদের ‘ব্যাঙ’। সৌমেন কর(মামা)-এর পায়ের কাজও ভালো ছিল। একটা দুটো গোল এক কলমচিও দিয়েছে । তবে ক্রিকেটের সাথে সাথে ফুটবল নিয়েও আগ্রহ ছিল একথা বলাই বাহুল্য । ঠিক যেমন আগ্রহ ছিল ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা নিয়েও।
তবে বয়স বাড়লেও তর্কের সেই উত্তেজনা যে কমেনি সেটা আঁচ পেলাম আমাদের নতুন ক্লাস ঘরের দেওয়ালে। মানে ফেসবুকের ওয়ালে আর কি! রক্তের রঙ সবুজ-মেরুন বলে দাবী করা অরিজিত দাস খেলার এক দিন বাদে যুক্তি-টুক্তি সাজিয়ে, পরিসংখ্যানের পরসা নিয়ে একটা ‘স্যাটাস’ দিলো। আর যাবে কোথায় । খেলায় জিতেছে ইস্টবেঙ্গল তারাও গরম গরম মন্তব্যে ভরিয়ে দিল  অরিজিতের ফেসবুকের দেওয়াল।
ব্যাস শুরু হয়ে গেল লড়াই। বেশ মজার! খোঁচার পাল্টা খোঁচা, তার জবাবে আবার খোঁচা। তার  উত্তরে আরেক খোঁচা। এত খোঁচাখুঁচি হলে আহত হবার সম্ভাবনা থাকেই। হলও তাই। এক বন্ধু আহত হলেন। অভিমানের রক্তপাতও হোল ,তবে কিঞ্চিৎ! তিনি ব্যক্তিগত স্তরে অনুযোগ করলেন। কিন্তু তার অনুযোগ মিটতে সময় লাগল খুব বেশি হলে তিরিশ সেকেন্ড। আরে বাবা ‘ইয়ে ফেভিকল কা মজবুত জোর হ্যায়, টুটেগা নেহি’।
হ্যাঁ সে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান হোক বা সি পি এম- তৃণমূল। স্কুলের বন্ধুদের ‘মজবুত জোর’-এর দেওয়ালে ফাটল ধরাতে এরা কখন পারেনি আর পারবেও না।
কলকাতার ফুটবল নিয়ে আমার ব্যক্তিগত উৎসাহ আজ আর নেই। নিয়মিত খেলাও দেখিনা , বলা ভাল কখনও দেখার সময় পাইনা আবার কখনও ইচ্ছে করে দেখি না । এর একটা কারণ অবশ্যই এই ক্লাবগুলির কিছুকিছু কর্মকর্তারা। যারা মনে করেন ক্লাবগুলি তাদের মৌরসি পাট্টা।
তবুও একজন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হয়ে ভালো লাগে যখন  জাতীয় লিগ জেতার পর সুদূর আমেরিকায় আকাশে অরিজিত মোহনবাগানের পতাকা ওড়ায়। আমেরিকায় অরিজিতের বাড়ির জানলা দিয়ে উড়তে থাকা পতাকা ১৩,৯২৭ কিলোমিটার দূরে এসে কলকাতায় কোথায় যেন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ছাড়িয়ে বাঙালির কথা বলে।
আসলে পতাকার রঙ যাই হোক না কেন সেটা বাঙালির ফুটবলের পতাকা। যে বাগালি হয়তো বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নও দেখেননা কিন্তু মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে তার নিজের ক্লাবকে। হয়তো পুরটাই আবেগ, কিন্তু এই আবেগ তো আসলে ফুটবলের প্রতি ভালবাসারই। তাই বেঁচে থাকুক তর্ক, বেঁচে থাকুক ফুটবল নিয়ে ঝগড়া আর বেঁচে থাকুক ‘বাঙালির প্রিয় ফুটবল’।
অরিন্দম চ্যাটার্জি