আমার
ক্লাসের ‘লম্বা’ বন্ধুটি
লম্বা, দীর্ঘ সারিবদ্ধ ছেলে-মেয়েদের
মধ্যে মধ্যে তাকে বিশেষ ভাবে চোখে পড়ছে। উচ্চতায় অন্যদের বেশ খানিকটা পিছনে ফেলে নিজের ডান হাত দিয়ে
মাঝে মাঝে মাথা চুল ঠিক করে নিতে নিতে এদিকে ওদিক দেখে নিচ্ছে সে। কিছুটা বিরক্ত, আর কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে
কে জানে! এমন একটা ভাব। হাফ
হাতা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। বাঁ হাতে একটা সবুজ ফাইল। সেই ফাইলটা কখন কখন মাথার উপর
তুলে বেলা সাড়ে বারোটার রোদকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। লাইনে দাঁড়ানো সবাই কেউ সোজাসুজি
আবার কেউ আড়চোখে অন্তত একবার হলেও দেখে নিচ্ছে তাকে। তার কারণ একটিই। ছেলেটির উচ্চতা। গঙ্গাতীরের বঙ্গবাসীর কাছে
‘লম্বা’ মানেই বিগ বি, আর এই সেই বিগ বি –কেও এই ছেলেটি চ্যালেঞ্জ
ছুঁড়ে দিয়েছে হাসতে হাসতে। সে আর কেউ নয় আমার স্কুল বেলার ‘লম্বাতম’ বন্ধু শুভদীপ বিজয় ভট্টাচার্য।
জীবনে একবারই আমি সরকারি চাকরির
জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তখন কলেজে পড়ি সেই সময় টালিগঞ্জের পি এস সি অফিসে সরকারি
চাকুরীর পরীক্ষার ফর্ম জমা নেওয়া হোতো। পাড়ার সবার বিনে পয়সায় হাত দেখে বেড়ান বল্টু দা জোর করে আমার
হাতটা টেনে নিয়ে সেটা দেখে বলেছিল, ‘চান্স তো নে ,লেগে গেলেও লেগে যেতে পারে’। তবে আমার ওটাই ছিল প্রথম এবং
শেষ ‘চান্স
নেওয়া’। এবং সমস্ত জ্যোতিষের মতোই বল্টুদার
গননাও ‘ফেল’ করেছিল। সেই ফর্ম জমা দেওয়া লাইনেই
আমার সামনে দাঁড়ান বেশ কিছু ছেলেমেয়ের আগে শুভদীপকে পিছন থেকে দেখাই চিনতে পেরেছিলাম। এ শুভদীপ বিজয় ছাড়া আর কেউ
হতেই পারে না। দিলাম
এক ডাক, একবার
...দুবার...তিনবার ডাকতে যাবো ঘাড় ঘুড়িয়ে হাত নাড়ল সে। পিছনের ছেলেটিকে লাইন রাখতে
বলে বেড়িয়ে আমার সামনে এসে হাজির। এর মধ্যে অনেকেই তাকে মাথা ঘুড়িয়ে ,চশমা নামিয়ে দেখছে। কেউ কিছুটা অবাক চোখে কারো
চোখের ভাষায় লেখা , ‘ইস্
আমি যদি আর একটু লম্বা হতাম!’ এতো গেলো সোজাসুজি দেখা। আড় চোখেরও বেশ কিছু দৃষ্টিতে
নানা ভাষা লেখা ছিল। একে
৬ ফুট ৩ ইঞ্চি তার উপর ফর্সা রঙ, সুন্দর চেহারা । এককথায় যাকে বলে সুপুরুষ, এহেন সুপুরুষকে আড়চোখে যে দেখাদেখি হবে সেকথা বোধহয়
শুভদীপের ততদিনে গা সওয়া হয়ে গেছে। সেই কারণেই সে ঐ সব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে আমার সামনে হাজির
হয়ে প্রথমেই বলল, ‘লম্বা
লাইনটা দেখেছিস’? কথার
মধ্যে যেন মার্চ মাসের দুপুরে বিশ্বায়ন, উষ্ণায়ন, দেশ- রাজ্যের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিল্প, কৃষি, রাজনীতি নানা রকম বিষয়ের
অভিব্যক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। লাইনের দৈর্ঘ্য টালিগঞ্জের
পি এস অফিসের গেট থেকে পাশের রাস্তা দিয়ে পি এস সি অফিসকে অর্ধেক চক্কর মেরে বেশ কিছুটা
এগিয়ে গেছে। পি
এস সি অফিসের সামনের ফুটপাতে বেশ কয়েক জন বই বিক্রেতা চাকুরীর পরীক্ষার বই নিয়ে বসে
আছে।
সঙ্গে আছে অন্য অন্য চাকরির ফর্ম। সেখানে কিছু ছেলেমেয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে। কেউ কেউ ফর্ম গুলিকে
খুঁটিয়ে দেখছে , যেন সেগুলি একেকটি লটারির টিকিট। এদের মধ্যে কেউ আমাদের মতই কলেজ ছাত্র আবার কারো চুলে তখনই
হালকা পাক ধরেছে।
‘চল একটা ব্যবসা করি’। চাকরির পরীক্ষার ফর্ম জমা দেবার লাইনে দাঁড়িয়ে নতুন ব্যবসার
পরিকল্পনা! বিষয়টা শুধু অভিনবই শুধু নয়, বিল গেটস বা জুকেনবার্গ
সাহেব শুনলেও হয়ত কিছুটা অবাকও হবেন। কথাটা শুনে লাইনে দাঁড়ানো আমার সামনের চশমা পরা ছেলেটা চশমার
ফাঁক দিয়ে সম্ভবত অবাক হয়েই ফিচেল চোখে একবার
তাকিয়ে ছিল, মনে
আছে। সে
যাই হোক ‘লম্বু’-এর সঙ্গে সেদিন আর ব্যবসার
পরিকল্পনার কথা এগোয় নি। এই নিয়ে অন্য একদিন বসে আলোচনা করা হবে এই কথা দিয়ে যে যার
বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম। তখন বি এস এন এল-এর ল্যান্ড ফোনের যুগ। চাকা ঘুড়িয়ে নম্বর ডায়াল
করা ফোনের জায়গায় সদ্য এসেছে বোতাম টেপা ফোন। ইন্টার নেট ই-মেল এই বস্তু গুলো আমাদের জীবনে তখনও পা রাখেনি
তাই অগত্যা ফোন নম্বর আদানপ্রদান।
ফোন নম্বর আদানপ্রদান হয়েছিল
ঠিকই কিন্তু তখন তো জানতাম না মানুষের ভিড়ে এই ভাবে হারিয়ে যাবো আমারা। তাই হয়তো বাসের টিকিটের পিছনে
লেখা ফোন নম্বর মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে কখন হারিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। তবে ফোন নম্বর হারালেও স্মৃতিটা
অক্ষত আছে। যত
দিন বেঁচে থাকব সে হারাবেও না। তাই যখন একা থাকি, কিংবা কোন কারণ ছাড়াই যখন মন খারাপ হয় অথবা যখন জীবনে কিছুটা
বাড়তি অস্কিজেন দরকার হয় তখন আমি ফিরে যাই, নিউ আলিপুর মাল্টিপারপাস-এর ক্লাসঘর গুলোয়। আর সেই সুযোগে ক্লাসঘরগুলো
সুযোগ পেলেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমাকে।
সেই স্মৃতি সরণীতেই দেখতে পাচ্ছি
সেই ফেলে আসা দিনগুলি যখন প্রথম আমাদের বন্ধুদের তালিকায় যুক্ত হল শুভদীপ বিজয় ভট্টাচার্য। সাদামাটা ছেলে। পড়াশুনায় মধ্য মেধার, শান্ত, অল্প কথা বলে। বিশেষত্ব একটাই ‘লম্বা’। ক্লাসের কেউ কেউ দুষ্টুমি করে
‘দাদা’ , ‘কাকা’, ‘মামা’ বলেও সম্বোধন করতে লাগল। আমারা যারা একেবারে ইনফ্যান্ট
থেকে একসঙ্গে পড়ছি তাদের সঙ্গে প্রাথমিক অবস্থায় কিছুটা দূরত্ব ছিল শুভদীপের। তবে বাকিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব্ব
হতে সময় বেশি লাগলো না। বছর
ঘুরতে না ঘুরতেই আমাদের বন্ধু হয়ে উঠল।
বেশ ভালোই জমে উঠেছিল আমাদের
বন্ধুত্ব, ঝগড়া, তর্ক ,মারামারি। এমনই একদিন শুভদীপ এসে জানালো
সে চেতলার ‘রাখি
সঙ্ঘ’ ক্লাবে
বাস্কেট বল খেলতে শুরু করেছে। সেদিন আমার ধারণা হয়েছিল সে একজন ভালো বাস্কেট বল খেলোয়াড়
হবে।
হয়ত লম্বা বলেই। তখন পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট কোচিং সেন্টার গুলি এখনের মতো গজিয়ে
ওঠেনি। সৌরভ গাঙ্গুলি তখন বাঙলা দলে খেলার জন্য চেষ্টা করছেন। তার মধ্যে বাস্কেট বল বেশ
অভিনব ব্যবপার ছিলো। আমার ধারণা ছিল এই খেলা আমেরিকার কালো মানুষরাই বুঝি
খেলে। শুভদীপ মাঝে মাঝে এসে গল্প করতো তার খেলার। আমরাও বেশ উৎসাহ নিয়ে শুনতাম। তারপর স্কুলের পাট শেষ হোল। স্কুলের গেট পেরিয়ে হাজির হলাম
এক মজার জায়গায়। যাকে
বলে বৃহত্তর সমাজ। সামনে
তখন গোটা পৃথিবী। আর
সেই নতুন পৃথিবীতে মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে আমাদের কোন বাঁধা ছিলনা। আমারা মিশেও গেলাম জনসমুদ্রে। সেই সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে নিউ
আলিপুর পেরিয়ে গোলপার্ক, পেরিয়ে
চাকরি আর চাকরি পেরিয়ে ব্যবসা, সংসার, মাথায় একটা দুটো করে
সাদা চুলের উঁকিঝুঁকি আরও কতো কি।
বাসের টিকেটের পেছনে লেখা ফোন
নম্বরের মতো কখন যেন হারিয়ে গেল অনেকটা সময়ও। তবে বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত
যতবার চেতলার পথ দিয়ে চলাফেরা করেছি অনেক অনেক স্মৃতির ভিড়ে একবার উঁকি দিয়েছি ‘ রাখি সঙ্ঘ’ –এর বাস্কেট বল মাঠে। যদি দেখতে পাই আমার হারিয়ে
যাওয়া বন্ধুকে। যদি
খুঁজে পাই সেদিনে সেই হারিয়ে যাওয়া বাসের টিকিটটা। না পায়নি। জানি পাওয়া সম্ভবও না। কিন্তু আমার বন্ধু কখনই হারায়নি। তার সঙ্গে আজও হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, স্মৃতির সরণীতে। যেমন
আজ হল। অনেকটা
সময়ও কাটালাম। আড্ডা
হোল অনেকক্ষণ। তবে
বলতে পারবো না এখন তাকে দেখতে কেমন? মোটা হয়েছে না রোগা, বলতে পারব না তার মোবাইল নম্বর বা ই-মেলের ঠিকানা। তবে তার একটি বাসা আমি বিলক্ষণ
চিনি , সেটি
আছে আমার মস্তিষ্কে। যেটা
আমার স্কুল বেলার এক আস্ত কলকাতা, যার প্রতিটি গলিতে ,যার প্রতিটি রাস্তাতে আমার এক একজন বন্ধুর বাড়ি ,আমার ছেলে বেলার ঠিকানা। সেই শহরের ছোট্ট একটা
গল্প রইল সবার জন্য।
-অরিন্দম চ্যাটার্জী
-অরিন্দম চ্যাটার্জী